একজন মেয়ের নারী হয়ে ওঠার লড়াই | বইয়ের রিভিউ


একজন মেয়ের নারী হয়ে ওঠার লড়াই | বইয়ের রিভিউ


রিভিউ করেছেন : রেহনুমা রুবায়েত প্রাপ্তি

 

বই: সাতকাহন (প্রথম পর্ব)

লেখক: সমরেশ মজুমদার

 

মেয়েছেলের আবার এইটা, তুই তো মেয়েছেলে….

এই ❝মেয়েছেলে❞ শব্দটা শুনলেই রেগে যায় দীপা। মেয়েছেলে আবার কী? হয় মেয়ে না হয় ছেলে।

দীপাবলী মুখোপাধ্যায়। ১১ বছর বয়েসী প্রাণবন্ত এক কিশোরী। ভোর বেলা শিউলি তোলা, মা-বাবা, ঠাকুমাকে ফাঁকি দিয়ে পাড়ার ছেলে বন্ধুদের সাথে মাছ ধরা, ঠাকুর দেখতে যাওয়া আর সন্ধ্যের আগেই মায়ের বকুনি থেকে বাঁচতে লুকিয়ে বাড়ি ফেরা। জলপাইগুড়ির চা-বাগানে এইতো দীপার সুন্দর জীবন।

জীবন তো সবসময় এক বাঁকে চলে না। মোড় নেয়। দীপার জীবনও মোড় নিয়েছিল। চা-বাগানে দৌড়ে বেড়ানো দীপার জীবন যুদ্ধ শুরু হলো বাল্যবিবাহ দিয়ে। বিয়ের আগের রাতে জানতে পারে তার জীবনের এক নির্মম সত্য। এতদিন যাদের মা-বাবা বলে জেনে এসেছে তারা আসলে দীপার মাসি আর মেসো। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে আবার নিজের জীবনের নির্মম সত্য জেনে মুষড়ে পড়ে দীপা।

দীপাবলী মুখোপাধ্যায় থেকে হয়ে যায় দীপাবলী বন্দোপাধ্যায়। বিয়ে তার জীবনে সুখ বয়ে আনেনি। সিঁথিতে সিঁদুর আর হাতের শাখা তার হাতে শোভা পেয়েছিল মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টার জন্য। এরপরেই বিধবার খাতায় নাম উঠে যায়। পঞ্চাশের দশকে একজন বিধবার যে কঠিন নিয়মে চলতে হতো সে নিয়মে চলতে বাধ্য করে দীপার ঠাকুমা মনোরমা। কিন্তু সে তো নিয়মে বাঁধা পড়তে চায় না। বিদ্রোহ করার শক্তি তখনো নেই। জীবনের কঠিন যুদ্ধে আশার আলো বিদ্যার্জন। সত্যসাধন মাস্টার আছেন দীপাকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য। আরো আছেন আধুনিক মানসিকতার রমলা সেন।

অঞ্জলি-অমরনাথ কখনও দীপাকে বোনের মেয়ে হিসেবে দেখেনি। নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করেছে। অকাল বৈধব্য বরণ করে নেয়ার জন্য যেন নিজেদেরই দায়ী করেন তারা। তাই দীপাকে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে নিয়ে যেতে তারা দুইজন বদ্ধ পরিকর।

সময় এগিয়ে যায়। স্কুল পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে পাশ করে ভর্তি হয় জলপাইগুড়ির কলেজে। শুরু হয় হোস্টেলে নতুন জীবন।

অতীত তবু পিছু ছাড়ে না। নামের শেষের বন্দোপাধ্যায় পদবী বয়ে বেড়াতে হয় তাকে। ভুলে যেতে চায় সে বিয়ের পরের সেই রাতের ঘটনা। নানা ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে আই এ পাশ করে ফার্স্ট ডিভিশনে। ভর্তি হয় কলকাতা শহরের স্কটিশ চার্চ কলেজে। কলকাতার মতো বড়ো শহরেও দানা বেঁধে আছে সেইসব পুরোনো সংস্কার। মেয়েদের পিছিয়ে রাখার সংস্কার। কিন্তু দীপারা থেমে যায় না। বিদ্রোহ করে এগিয়ে যায়। সংস্কার মুছে নিজেকে প্রমাণ করে।

একসময় কাছের মানুষগুলো কেমন অচেনা হয়ে যায়। একসময়ের ভালোবাসা স্নেহ যেন সব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সম্পর্কের তার কোথাও যেন কেঁটে যায়। কলকাতা শহরে একা একদম একা এক তরুণী সে। নেই কোনো আপনজন।

ভুলে যেতে চাওয়া সেই বিবাহের সম্পর্কের জের ধরেই লক্ষ টাকার সম্পত্তি পেয়েও তা দান করে দিতে চায় দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। দেখতে পায় আশেপাশের মুখোশ পরে থাকা সেই লোভী মানুষগুলোকে। যারা স্বার্থে একটু আঘাত লাগতেই চোখের পলকে কেমন বদলে গেলো।

এই কি জীবন? দীপা পারবে সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে জীবন যুদ্ধে বিজয়িনীর আসনে বসতে? এমন তো হাজারো দীপা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সেই সময়ের কলকাতায়!

পাঠ প্রতিক্রিয়া:

দীপাবলি বন্দোপাধ্যায় যেন তৎকালীন কলকাতার অধিকার আদায়ে বদ্ধ পরিকর সকল মেয়েরই প্রতিচ্ছবি। বইতে দেশভাগের পরের কলকাতার চিত্র লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। আরো আছে সরকার বিরোধী আন্দোলন, ছাত্র রাজনীতি, সংস্কারের নামে কুসংস্কার আর সব কিছুর মাঝে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করতে থাকা এক তরুণী। খুবই সহজ ভাষায় সে সময়ের একটা চিত্র লেখনীতে ফুটে উঠেছে। দীপার জীবনের মনস্তত্ত্ব, ভেতরের কান্না, সম্পর্কের টানাপোড়ন, একা জীবন আর চারপাশের মানুষগুলোর অবাক করা ব্যবহার তাকে নাড়িয়ে যাচ্ছিল পুরোটা সময়। তবুও দমে যায়নি সে। সত্যসাধন বাবুর মতো মাস্টার, অমরনাথের মতো বাবা, মনোরমার মতো ঠাকুমা, মায়া-রাধার মতো বান্ধবী, মায়ার মায়ের মতো একজন মন খুলে কথা বলার একজন মানুষ দীপার জীবন চলার কণ্টকাকীর্ণ পথে এনে দিয়েছিল একটু প্রশান্তি। দীপা থেমে থাকেনি, এগিয়েছে পথের পথিক হয়ে। আরো এগোতে হবে। নিজেকে সেই স্থানে নিতে হবে যেখানে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ করার সুযোগ থাকবে না। তাতে গোরা মানসিকতার মানুষেরা যতোই চোখ ঠোঁট উল্টে যাক কেন।

লেখক দীপার চরিত্র সাজিয়েছেন মনের মাধুরী দিয়ে। সুখ-দুঃখবোধ, জীবনে চাওয়া-পাওয়া, ভালোবাসা আর এক গম্ভীর ব্যক্তিত্বে ভরা এক তরুণী হিসেবে দীপাকে সাজিয়েছেন লেখক। কখনও সে গম্ভীর, কখনও সে চোখের জলে সিক্ত এক নারী যার জীবনে আপন বলতে খুব বেশি কেউ নেই। প্রতিনিয়ত যে দিচ্ছে অগ্নিপরীক্ষা। দীপার চরিত্র বিন্যাসে লেখক শতভাগ সফল।

দীপাবলীর জীবনের প্রিয় মুখগুলোর হারিয়ে যাওয়া দেখে একটা লাইনই মন আওড়াচ্ছিল,

❝যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।❞

বইটা পড়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিল আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কি নারীরা মুক্ত? সেই শিকল কি অদৃশ্য ভাবে এখনো পড়ানো নেই নারীদের পায়ে?

পূর্ববঙ্গের ব্যাপারে কিছু তথ্য ছাড়া আগাগোড়া পুরো উপন্যাসই ভালো লেগেছে। যেখানে যেমনটা অনুভব করার ঠিক তা-ই করেছি। একসময় মনোরমার উপর খুব ত্যক্ত লাগছিল। এরপর লেখকের লেখার গুনে সেই তিক্ততা গিয়ে পড়লো অঞ্জলির উপর। মুহূর্তেই কীভাবে একজন মানুষ ভোল পালটে ফেলে সেটা অঞ্জলি, সুভাষের মতো চরিত্র থেকে খুব ভালো করে বুঝে ফেলে যায়।

বই : সাতকাহন (দ্বিতীয় পর্ব)

লেখক : সমরেশ মজুমদার

 

❝ঈশ্বর যদি মানুষকে অন্তত একদিনের জন্যে অন্যের মনের কথা পড়ার ক্ষমতা দিতেন তাহলে নব্বইভাগ মানুষ কেউ কারো সঙ্গে থাকতে পারত না।❞

মনে মনে কত কিছুই তো আমরা ভাবি। বলতে পারি তার কয়টা? বলি না বলেই কি আশেপাশের সম্পর্কগুলো টিকে আছে?

দীপাবলী। বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে প্রথম জীবনেই বৈধব্যের শিকল পড়া এক ছোট্ট মেয়ে। পরবর্তীতে যে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়। নানান টানাপোড়নের মাঝে যে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক সংগ্রামী নারী। দেশভাগ পরবর্তী ভারতের কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছে।

প্রথমে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নেখালিতে জয়েন করে দীপাবলী। সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার আর টাকার কাছে সরকারি কর্মকর্তাদের বিকিয়ে যাওয়া দেখে হাল ছেড়ে দেয়। দেশের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এমন ব্যক্তিত্বহীন দশায় সে নিজেকে দেখতে চাইছিল না। কলকাতা ফিরে আবার আই আর এস পরীক্ষা দিয়ে ইনকাম ট্যাক্স কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেয় দিল্লিতে। কলকাতার গন্ডি পেরিয়ে এ এক নতুন জীবন। জীবনসঙ্গী হিসেবে খুঁজে নেয় অলোক মুখোপাধ্যায়কে। দীপাবলী আবার হয়ে যায় দীপাবলী মুখোপাধ্যায়। জীবন আসলেই চক্রের মতো ঘূর্ণায়মান।

জীবন সংসারে একলা দীপাবলী অলোককে নিয়ে টোনা-টুনির সংসার পাতে। চাকরি জীবনের সমস্যা এখানেও। সরকারি কর্মকর্তাদের যে নিয়ম শিখিয়ে নিয়োগ দেয়া হয় বাস্তবে তার ষোলো আনাই মিছে। অন্যায়ের সাথে আপোষ না করা দীপাবলী নিয়ম মেনেও যেনো এক অনিয়ম।

ভালোবেসে যাকে জীবনসঙ্গী করেছিল দেখা যায় তার সাথে মতের অনেক বিরোধ। তীব্র আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দীপাবলী সব দেখেও নির্বিকার। সংসার করছে করতে হবে তাই। শুরু থেকেই সংগ্রাম করা এক নারী সংসার জীবনেও একাকীত্বে ভুগতে শুরু করে। বিয়ের আগের অলোক আর পরের অলোক কতটা তফাৎ? মানুষ বদলায়, কিন্তু কতখানি?

জীবন দীপাবলীকে আবার ফিরিয়ে আনে কলকাতায়। শুরু হয় আবার একলা জীবন। চাকরি আর সংসার জীবনের টানাপোড়ন, পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সব নিয়েই চলে যাচ্ছিল দীপার জীবন। শেষে ঠাকুমা মনোরমাকে নিয়ে বাস শুরু করে দীপাবলী। এভাবেই চলবে? আত্মমর্যাদাবোধ কি ভালোবাসা থেকেও দামী?

পাঠ প্রতিক্রিয়া:

প্রথম খন্ড পড়ার পরে দীপার জীবনে কী হলো জানতে উদগ্রীব ছিলাম। দ্বিতীয় খণ্ড পড়ে মনে হচ্ছে না পড়াই ভালো ছিল।

সত্তর আশির দশকের ভারতবর্ষ, তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দুর্নীতি, অনিয়মকেই নিয়ম বানিয়ে দিব্যি বসবাস করা মানুষগুলোর মাঝে স্রোতের বিপরীতে এক অদম্য নারী দীপাবলী। প্রথম জীবনে সামাজিক অব্যবস্থার শিকার এবং পরবর্তীতে নিজের ভাগ্য বদলে বাবা এবং মাস্টারের স্বপ্ন পূরণ করে দীপাবলী এগিয়ে যায় জীবনে। লেখক তৎকালীন ভারতবর্ষের নানা সমস্যার কথা বেশ সাবলীলভাবে লিখেছেন। পুরো উপন্যাসের সিংহভাগই ছিল দীপার চাকরি জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে। সৎ থেকে হাজারো অসৎ ব্যক্তির মাঝে কাজ চালিয়ে যাওয়ার যে স্পৃহা তার মধ্যে ছিল লেখক সে বিষয়গুলোই মোটা দাগে দেখিয়েছেন। থিওরি আর প্রাকটিসের মধ্যে বিস্তর এক তফাৎ, যা দীপাবলী চাকরি জীবনে টের পেয়েছে।

পরিবার জীবনেও দীপাবলীর ভাগ্যে সুখ বেশিদিন জোটেনি। এক হাতে যেমন তালি বাজেনা তেমনি দোষ ছাড়া মানুষ হয় না। কেউই ❝পারফেক্ট❞ নয়। পৃথিবীর সকল দুঃখ উপরওয়ালা দীপাবলীকে এমনি দিয়েছেন না সেজন্য সে নিজেও সিকি ভাগ হলেও দায়ী এমনটা কি না সেটা যারা পড়েছেন বইটি তারা ভালো বুঝেছেন।

দীপাবলীর জীবনে সংগ্রাম, অন্যায়ে আপোষহীনতা, আত্মমর্যাদাবোধ যেমন আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করেছে তেমনই তার চরিত্রের কিছু দিক আমাকে খুবই হতাশ করেছে। মাঝে মাঝে বিরক্ত ধরিয়ে দিয়েছে।

বিশেষ করে উপন্যাসের সমাপ্তিটুক। ফেইরী টেলসের মতো ❝𝘏𝘢𝘱𝘱𝘪𝘭𝘺 𝘦𝘷𝘦𝘳 𝘢𝘧𝘵𝘦𝘳❞ টাইপ হবে আশা করিনি। তবে তার শেষ পর্যায়ের আত্মমর্যাদাবোধ আমার চোখে দীপাবলীকে অহংকারী এবং স্বার্থপর একজন নারী হিসেবে দেখিয়েছে। মনোরমার সাথে সে নিজের ছেড়ে আসা জীবনের যে তুলনা করেছে সেটা আমার কাছে অমূলদ লেগেছে। মনোরমার মতো দীপাবলীর জীবন থেকে বিনা কারণে পঞ্চাশ বছর নিশ্চয়ই হারিয়ে যায়নি। আর মনোরমার ঘটনাটা একেবারেই এক পাক্ষিক ছিল। যেখানে দীপাবলীর ক্ষেত্রে সে একদম তুলসী পাতা অবশ্যই ছিল না।

জীবনের শুরুর দিকে মনোরমা দীপাবলীর সাথে যে অন্যায় করেছে সেটা ভুলে সে মনোরমা কে কাছে ঠেলার সময় আত্মমর্যাদার কথা ভাবেনি। এই ব্যাপারগুলো আমার কাছে দৃষ্টিকটু লেগেছে খুব।

প্রথম পর্বকে অসাধারণ বললে দ্বিতীয় পর্বকে সাধারণ মানের বলা যাবে।

লেখক উপন্যাসের শুরুর দিকে লিখেছেন, ❝এক ফোঁটা ভালোবাসার জন্যে যদি কোন মানুষ লক্ষ মেইল হেঁটে যেতে পারে তাহলে একটা পুরো সমুদ্র পেলে সে কি করবে?❞

বই পড়া শেষে এই উক্তি নিয়ে আমার বক্তব্য হবে, ❝কিছুই করবে না। পা আছে না কি তাই ভুলে যাবে।❞

সবই আমার ব্যক্তিগত মতামত। লেখকের লেখনশৈলী নিয়ে কোনোভাবেই প্রশ্ন তুলছি না।