ক্রিকেটের আলোর পেছনে আছে অন্ধকার | বইয়ের রিভিউ


ক্রিকেটের আলোর পেছনে আছে অন্ধকার | বইয়ের রিভিউ


বই : তৃতীয় রিপু (ক্রিকেটীয় কিন্তু ক্রিকেট নয়)

লেখক : সোমনাথ সেনগুপ্ত

রিভিউ লেখক : সাকিব আহমেদ

প্রচ্ছদ : জাওয়াদ উল আলম

প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি, ২০২২

প্রকাশনী : ঈহা প্রকাশ

পৃষ্ঠা : ২৮৮

মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা

 

এই উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলাকে কীভাবে বর্ণনা করা যায়? যেখানে একটি খেলা আবেগের সাথে সম্পর্কিত, ভালোবাসায় পরিপূর্ন; সেই খেলাকে বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া খুব একটা সহজ নয় বোধহয়। হ্যাঁ, এই উপমহাদেশের মাটিতে ক্রিকেট খেলাটা এমনই। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান কিংবা শ্রীলংকায় ক্রিকেটের নামে উৎসব হয়। এই উৎসবে এক হয়ে মিশে যায় নানা বর্ণের, নানা ধর্মের মানুষ।

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় কেবল একটি নাম, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। তর্কে বিতর্কে আসর জমে। ক্রিকেটকে ছেড়ে থাকা যায় না। বিজয় যেমন আনন্দের আবেশে জড়িয়ে রাখে, পরাজয়ে তেমনই আক্ষেপে মন পোড়ে। দু’চোখের কোণে অশ্রু জমে। জেদের বসে কেউ কেউ বলে, “দেখবোই না খেলা!” তারপরও প্রিয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়ে আবার খেলা দেখতে বসে যাওয়া। ওই খেলাটাকে যে প্রচুর ভালোবাসা যায়। মতভেদ থাকতে পারে, থাকতে পারে ধর্মের বিভেদ। তবুও সবাই এক জায়গাতেই এক হয়ে যায়। ক্রিকেট আর বাংলাদেশ। ওরা একসাথে হাসে, একসাথে কাঁদে। চিৎকার করেও একসাথে। ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ নামে মুখরিত হয় চারিপাশ।

ক্রিকেটের এই উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আয়েশ করে, কিংবা কড়া সূর্যের উত্তাপে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবার ভিন্ন ভিন্ন আত্মা এক হয়ে মিলেমিশে যায়। সবার মনে একটাই আশা, একই আবেগ। কিশোর থেকে তরুণ, তরুণ থেকে বৃদ্ধ; সবার মনে ক্রিকেটের বাইশ গজে যে ভালোবাসার জন্ম নেয়, প্রতিটি জয়ে কিংবা পরাজয়ে যে আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হতে হয়; তার মধ্যে কোনো খাদ নেই।

খাদ আছে খোদ ক্রিকেটে। যাদের জন্য ক্রিকেট খেলাটার প্রতি এ ভালোবাসা, যাদের দেখে এই ক্রিকেট প্রেম; তারা কি সত্যিই ক্রিকেট খেলে? না-কি কারো হাতের পুতুল হয়ে ওই বাইশ গজে সেই দৃশ্য-ই মঞ্চস্থ করে, যা তাকে শেখানো হয়? ঠিক যেভাবে পুতুল নাচের গল্প চলে। ক্রিকেটের উজ্জ্বল আলোর পেছনে আছে অন্ধকার। আছে মিথ্যের হাহাকার। চলুন সেই অন্ধকার জগতে প্রবেশ করি। দেখি, ক্রিকেটের সুস্থ দেহে কীভাবে এক তীব্র অসুখ ছড়িয়ে পড়েছে। যেই অসুখের বিস্তৃতি এতটাই বিশাল যে, কোনোভাবেই তা নিরাময় করা সম্ভব নয়। আর এভাবেই ক্রিকেট খেলাটা মরে যাচ্ছে। একটু একটু করে শেষ শ্বাসটুকু হারিয়ে যাচ্ছে।

 

তৃতীয় রিপু ও ক্রিকেট :

কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাৎসর্য – এই ছয়টি অভ্যাস কিংবা বদভ্যাসকে একত্রে বলা হয় ষড়রিপু। আমাদের জীবনে এই ছয়টি রিপুর প্রভাব অনন্য। এই ছয়টি রিপুর প্রভাবে একজন মানুষ নিজের মূল্যবোধ, নৈতিকতা হারিয়ে অমানুষে পরিণত হতে পারে। তাইতো আমাদের গল্পে তৃতীয় রিপুর (লোভ) প্রভাব অবিশ্বাস্য। যেখানে ভালোবাসাকেও টাকার দাড়িপাল্লা মাপা হয়!

বলা হয়, “লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।” লোভ করলে পাপ হয়, আর সে পাপে মৃত্যু অনিবার্য। আসলেই কি তাই? আরেকটি প্রবাদ দেখা যাক, “চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা।” ব্যাপারটা সাংঘর্ষিক হয়ে গেল না? লোভে পড়ে মানুষ চুরি করে। পাপ হয়। কিন্তু মৃত্যু হচ্ছে কোথায়? যতক্ষণ না ধরা না পড়া হয়, দিব্যি ভালো থাকা যায়। চোখের আড়ালে থেকে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে হারিয়ে দেওয়া যায় ক্রিকেট নামের ভালোবাসার খেলাকে।

সেই জন্য ফিক্সিংয়ের সাথে জড়িত হাজার ঘটনার মধ্যে সামান্য কিছু ঘটনা আমাদের সামনে আসে। আমরাও মেনে নেই, এমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা কেবল ক্রিকেটকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা। অথচ অনেকেই দাবি করেন, ক্রিকেটের সবগুলো খেলাতেই গড়াপেটা সম্ভব। কে জানে, হয়ত সবগুলো খেলাতেই গড়াপেটা হয়! আমাদের জানার এখতিয়ার যে সবখানে নেই।

 

যাত্রা হোক ক্রিকেটের অন্ধকারে :

ধরুন আপনি খেলা দেখছেন। টানটান উত্তেজনা চলছে। দুই পক্ষ সমানে সমানে লড়াই করছে। কে জিতবে বলা যাচ্ছে না। ব্যাটিং দলের পক্ষে জেতা খুব সম্ভব। আবার বোলিং দল এক দুইটি ভালো বল খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। পেন্ডুলামের মতো দুলছে খেলার ভাগ্য। তারচেয়েও দ্রুততর হচ্ছে হৃদযন্ত্রের ওঠানামা। এমন পরিস্থিতিতে হুট করে বোলারের অসাধারণ বোলিং, ব্যাটার ভুল করে আউট! কিংবা কোনো অদ্ভুত কারণে রান আউটে কাটা পড়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। কী মনে হবে তখন? চাপ নিতে না পেরে এমন ভুল? না-কি আগে থেকেই এমন দৃশ্য মঞ্চস্থ হওয়া নির্ধারিত হয়ে আছে? যদি তাই হয়, তাহলে কী আর ক্রিকেটে বিশ্বাস থাকে? যেই বিশ্বাস, আবেগ দিয়ে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা; তার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায় অচিরেই। যেন কোনো এক মৃদু ভূমিকম্পেও তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাবে আবেগ দিয়ে তৈরি ক্রিকেটের অট্টালিকা।

ক্রিকেটে এই ফিক্সিং শুরু হয় কবে থেকে? ক্রিকেটের সূচনালগ্ন থেকেই ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় বৈধ বেটিং পদ্ধতি চালু আছে। কিন্তু এই খেলাটা যখন উপমহাদেশে রাজত্ব করতে এলো, তখনই ঘটল বিপত্তি। দূরদর্শনের যুগ শুরু হওয়ার সাথে সাথে বেটিং যেন নতুন মাত্রা পেল। ছড়ানো শুরু হলো কালো টাকা। আর যেখানে কালো টাকার ছড়াছড়ি, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায় অপরাধের মাত্রা। কেতাবি ভাষায় যার নাম ম্যাচ ফিক্সিং। বাংলায় বলি, ম্যাচ গড়াপেটা বা ম্যাচ পাতানো।

বাংলাদেশে ম্যাচ গড়াপেটার প্রথম কেচ্ছা সামনে আসে মোহাম্মদ আশরাফুলকে দিয়ে। এর আগে যদিও মাশরাফি প্রস্তাব পেয়েছিলেন, তিনি দক্ষ হাতেই তা সামাল দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু আশরাফুল পারেননি। লোভে পড়েছিলেন। সাথে অনেকেই সাথী হয়েছিলেন। যাঁর বা যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের কেউ মুখে স্বীকার করেননি অপরাধের কথা। আশরাফুল স্বীকার করেছিলেন। এর শাস্তিও পেয়েছিলেন। এছাড়া সাকিব আল হাসানের গল্প তো এখনো পুরনো হয়নি। সাকিবের দোষ কেবল ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়েও আইসিসি বা বিসিবিকে না জানানো। কেন জানাননি? সেটা জানা যাবে না কোনোদিন। এর পেছনের গল্প সাকিবের মুখ বন্ধের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে।

ক্রিকেট ফিক্সিংয়ে সবচেয়ে বড়ো ধাক্কাটা বোধহয় খেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। বর্ণবাদের কারণে নিষিদ্ধ হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯২ সালে যখন আবার ক্রিকেটে ফিরল, সেদিন দলটির হয়ে অভিষেক হয়েছিল হ্যান্সি ক্রোনিয়ে নামের এক তরুণের। এত বছর পরও হ্যান্সি ক্রোনিয়েকে দেশটির সেরা অধিনায়ক ভাবা হয়। এমন একজন পথ ভুল করে হারিয়েছেন অন্ধকারে। ক্রিকেটের মতো খেলাকে অপবিত্র করেছেন। তার ফল হাতেনাতে পেয়েছেনও। কয়েকশ ফুট উঁচু থেকে যখন কার্গো বিমানটা মাটিতে পড়ছিল, কী ভাবছিলেন হ্যান্সি? নিজের কৃতকর্মের জন্য আক্ষেপ করছিলেন, না বেঁচে থাকার শেষ আকুতি ফুটে উঠেছিল চোখে মুখে। জানা যাবে না আর। আঁধার জগতের নিষ্ঠুর রাজনীতির বলি হয়ে হ্যান্সি হারিয়ে গিয়েছেন, হারিয়ে গিয়েছেন সম্ভাবনাময় এক ক্রিকেটার।

ক্রিকেটের ফিক্সিংয়ের আঁতুড়ঘর কাকে বলা যেতে পারে? স্বভাবতই পাকিস্তানের নামটা সবার আগে আসে। ক্রিকেট পাড়ায় প্রচলিত আছে, পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের খুব সহজেই কেনা যায়। এবং এই কথা যে সত্য, তার অনেক প্রমাণ নানা সময়ে দেখা গিয়েছে। এক দশক আগেই আসিফ-আমির নো বল কান্ড তো পুরো বিশ্ব তোলপাড় করে ফেলেছিল। আর এতে আমরা আমিরের মতো একজন সম্ভাবনাময় তরুণকে হারিয়ে ফেলেছি। এছাড়াও পাকিস্তান ক্রিকেটের কেলেঙ্কারি তো শেষ হবার নয়! “তৃতীয় রিপু” বইটি পড়তে গিয়ে এমন কিছু নাম দেখেছি, যাদের দেখে আমাদের নব্বই দশকের প্রজন্মের ক্রিকেট প্রেম শুরু হয়েছিল। অথচ তাঁরাই ক্রিকেটকে বিক্রি করে দিলো! ক্রিকেটে ফিক্সিং করা যায়- জুয়ার দুনিয়ায় এই বিশ্বাস যে পাকিস্তানিদের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল।

এবার আসি ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশটির কথায়। ভারতে ক্রিকেট খেলাটা ধর্মের মতো। আর খেলোয়াড়রা যেন তাদের দেবতা! সেই দেশেও ক্রিকেট ধর্মকে পায়ে পিষে মেরে ফেলার চেষ্টা চলেছে। টাকার গন্ধ পেয়ে ক্রিকেটাররা পাকিস্তানীদের পথে হাঁটা ধরেছিলেন। যার সূত্রপাত মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনকে দিয়ে। এছাড়াও ছিলেন অজয় জাদেজা, নভোজিত সিং সিধু প্রমুখ। একজন জুয়াড়ি তো আজহারউদ্দিনকে “ভয়ংকর অপরাধী মানসিকতার মানুষ” বলেও আখ্যায়িত করেছে। এছাড়াও এমন কিছু খেলোয়াড়ের নাম উঠে এসেছে, যা ঠিক বিশ্বাস করার মতো না। তৃতীয় রিপু বইয়ের লেখকের একটা আক্ষেপ ব্যক্ত করেছেন। ক্রিকেট খেলাটিকে বিক্রি করে দেওয়া, দেশের সাথে বেইমানি করা মানুষগুলো যখন গুরুত্বপূর্ন অবস্থানে যায়, ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করে; তখন লেখকের সাথে আমারও আক্ষেপ হয় বৈকি।

লেখকের সাথে আমিও একটা বিষয়ে একমত। ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বিশ ওভারের খেলা ঠিক পছন্দ হয় না। নিজের দেশ খেলে তাই দেখতে হয়। কিন্তু মন ভরে না। ক্রিকেটকে নষ্ট করে দেওয়ার মূল এই বিশ ওভারের মহাযজ্ঞ। আর সেই মহাযজ্ঞে ক্যান্সারের মতো আবির্ভাব হয়েছে আইপিএল নামক এক অসুখের। চারিদিকে আলোর রোশনাই, টাকার উড়াউড়িতে ক্রিকেট বিশ্বে আইপিএলের পথচলা ক্রিকেটের মৃত্যু যেন আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে টাকা-ই সব, সেখানে অনিয়ম, অপরাধ যে দানা বাঁধবে তা তো আর বলে দিতে হয় না। এই আইপিএলের অনিয়ম, দুই দলের নিষেধাজ্ঞা, ক্রিকেটারদের গ্রেফতার হওয়া, জুয়ার দুনিয়ায় ভারতীয় পুলিশের আঘাত বারবার আইপিএলের কঙ্কালটিকেই তুলে এনেছে। তবুও খেলোয়াড়রা আইপিএল-এ মজে থাকে। টাকার হাতছানি তো দূরে ঠেলা যায় না। আর হাতছানিতে আরও অনেকেই ছুটে আসে। শুরু হয় ক্রিকেটের সাথে অক্রিকেটীয় এক যুদ্ধ। যেখানে বারবার ক্রিকেট হারে, হারিয়ে যায় অন্ধকারে।

যেখানে টাকার ছড়াছড়ি, সেখানে মাফিয়া জগতের আনাগোনা থাকবে স্বাভাবিকভাবেই। আর মাফিয়ে জগৎ মানেই অপরাধের নিত্যনতুন পন্থা। যা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েন দুবাইয়ের ডন দাউদ ইব্রাহিম। আর সেখানে চলে ক্ষমতার প্রদর্শন, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া! ক্রিকেটের এই অসুখ নিরাময়ের চেষ্টা চললেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তির জোরে সেই চেষ্টা বিফলে গিয়েছে অসংখ্যবার। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের রাজনীতির এ মারপ্যাঁচ বোঝার সাধ্য তো সাধারণ মানুষের নেই।

 

পাঠ প্রতিক্রিয়া :

“তৃতীয় রিপু” বইটি পড়ে প্রথম যে অনুভূতি হয়েছিল, আমার মতো মানুষের এ বইটি পড়া উচিত হয়নি। আমি কেন, কোনো ক্রিকেট পাগল মানুষের এই বইটি পড়া উচিত নয়। আরেকদিক দিয়ে ভাবলে ক্রিকেটের এই অন্ধকার দিক জানাটাও জরুরি। লেখক সোমনাথ সেনগুপ্ত খুব সুন্দর করে সব তুলে ধরেছেন। প্রতি দেশের ম্যাচ গড়াপেটা ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে বেশ সুন্দরভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। ফিক্সিং ঘটনা যেহেতু উপমহাদেশের উপজীব্য, তাই লেখকের লেখায় উপমহাদেশের ঘটনাই বেশি এসেছে।

এছাড়াও লেখক বেটিং পদ্ধতি, কীভাবে ক্রিকেট নিয়ে জুয়া খেলা হয়; খুঁটিনাটি সব তুলে ধরেছেন। অতুল কুমার নামের একজনের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখক দাবি করেছেন, ক্রিকেটের সব খেলাতেই ফিক্সিং করা সম্ভব। এর পেছনে গাণিতিক ব্যাখ্যাও দেওয়া আছে। যাঁরা গণিতে পড়েননি, তাঁদের এই বিষয় বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। গাণিতিক ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে বাকিটুকু পড়ার অনুরোধ রইলো। যাঁরা বুঝতে পারবেন না, বারবার পড়বেন। আশাকরি বুঝতে অসুবিধা হবে না।

লেখক বইয়ের বেশ কিছু অংশে যৌক্তিকভাবে কিছু প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন। সাক্ষ্য প্রমাণ থাকার পরও অনেক অভিযুক্তকে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়নি। নানান অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘায়িত হয়নি তদন্ত। হয়ত অনেক কিছুই বেরিয়ে আসতে পারত। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মানুষগুলো তা চায়নি। লেখক এখানে পাঠকের জন্য ভাবনার দুয়ার খুলে রেখেছেন। পাঠক নিজেই ভেবে বের করতে থাকুক, পরবর্তীতে কী ঘটেছে। যেখানে অভিযোগ থাকার পরও অপরাধী চিহ্নিত করা যায়নি, সেখানে কারও বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলা যায় না। লেখক সে কাজটি করেননি। পাঠক নিজেরাই সনাক্ত করুক ক্রিকেটকে বিক্রি করে দেওয়া সেইসব মানুষগুলোকে।

“তৃতীয় রিপু” বইটি পড়ে খুব কষ্ট লেগেছে। যে সকল খেলোয়াড়দের নাম লেখক তুলে ধরেছেন, তাঁদের দেখেই আমাদের অনেকের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার সূচনা। এখনো অনেকে তাঁদের আইডল মনে করে। তরুণ অনেক ক্রিকেটারই তাঁদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বইটি পড়ে তাঁরা কী শিক্ষা পাবে জানি না, আমার শিক্ষাটা খুব একটা সুখকর ছিল না।

 

কিছু অসঙ্গতি :

বইটির কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরা জরুরি। সেগুলো যেন বিরিয়ানির মধ্যে এলাচি হয়ে বইটির গুণগত মান কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে।

▪️ বইয়ের বাংলাদেশ অংশে মাশরাফি নিয়ে গুরুতর অভিযোগ করেছেন লেখক। লেখকের অভিযোগ মাশরাফি ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও কেন বিসিবিকে আগে জানাননি? সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার বিসিবি জানতে পেরেছিল। তবে কী সংবাদপত্রে প্রকাশ না হলে মাশরাফি বিসিবিকে জানতেন না?

এই অভিযোগ নিতান্তই অমূলক। মাশরাফি সে সময় বিপিএলে ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের অধিনায়ক ছিলেন। ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব পাওয়ার পর তিনি তাঁর দলের কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। এরপর সাংবাদিকদের জানান, যেন দেশবাসী জানতে পারে। কেননা নিয়ম অনুযায়ী এ রকম কোনো প্রস্তাব পেলে হয় বিপিএল কর্তৃপক্ষ, না হলে নিজ দল কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করতে হয়।

তিনি নিজে বলেছিলেন, ঢাকা গ্লাডিয়েটরস ম্যানেজমেন্টের একাধিক কর্মকর্তাকে তিনি ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। দলটির মিডিয়া ম্যানেজার ক্রিকইনফোকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, তারা মাশরাফির কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়ে বিপিএল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে পরবর্তীতে বিসিবি জানতে পারে।

• বইয়ের শুরুর দিকে লেখক কিছু জায়গায় গত সপ্তাহে, গত মাসে এমন শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। এখানে তারিখ না সাল উল্লেখ করলে বুঝতে সুবিধা হতো।

• বইয়ের বিভিন্ন অংশে লেখক কিছু ভিডিও লিংক সংযুক্ত করে দিয়েছেন। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, একটা বই থেকে সে লিংকের মাধ্যমে ভিডিও কীভাবে দেখব? এমন উপায় যে আমার জানা নেই। কেউ জেনে থাকলে জানাতে পারেন।

• লেখক তাঁর অনুসন্ধানের খাতিরে বেশ কিছু উদ্ধৃতি হুবহু ইংরেজিতে তুলে ধরেছেন। কিছু জায়গায় বাংলা বা ইংরেজি অক্ষরে হিন্দি লিখেছেন। এই বইটি হয়ত এমন মানুষের হাতে যাবে, যারা ইংরেজি খুব ভালো বোঝেন। কিন্তু এমন মানুষও তো থাকতে পারে, ইংরেজিতে কিঞ্চিৎ দুর্বল। আবার যেহেতু বাংলাদেশে বই প্রকাশ পেয়েছে, সবাই হিন্দি বুঝবে এমনও কথা নেই। তাই ইংরেজি বা হিন্দিগুলো বাংলায় অনুবাদ হলে ভালো লাগত। কিছু জায়গায় লেখক অনুবাদ করেছেন। সব জায়গায় কেন নয়?

• এই অভিযোগ গুরুতর হতে পরে। একটি জায়গায় লেখক ইনজামাম উল হকের মতো মুসলিম, ধার্মিক একজন ক্রিকেটারের বয়ানে “ভগবান” শব্দটি বসিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যাপারটি ভালো লাগেনি। শব্দচয়ন আরও ভালো হতে পারত। ধর্মীয় দিক খুব স্পর্শকাতর। তাই এসকল বিষয়ে দুই বাংলার লেখকদের সচেতন থাকা ভীষণ প্রয়োজন।

 

বানান, প্রচ্ছদ, প্রোডাকশন :

বানানের ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলছি না। দুই বাংলার বানানে কিছু পার্থক্য থাকে বলেই ভিন্ন বানান গুলো মেনে নিলাম। কিছু মুদ্রণ প্রমাদ লক্ষ্য করেছি। সম্পাদনাজনিত ভুল ছিল কিছু জায়গায়। দুই বাংলার ভাষাগত ভিন্নতার কারণে তাও আমলে নিলাম না। প্রচ্ছদ ভালো লেগেছে। তবে আমার কাছে ভারতীয় সংস্করণের প্রচ্ছদ বিশেষ ভালো লেগেছিল। ঈহা প্রকাশের প্রোডাকশন কোয়ালিটি বরাবর ভালো। এই বইয়েও তার ব্যতিক্রম নয়।

 

আমার আক্ষেপ :

ক্রিকেট নিয়ে আমার আক্ষেপ বেশ পুরনো। ক্রিকেটের বিশ্বায়ন হতে না পারা বেশ পীড়া দেয়। তবে এখন মনে হয়, ক্রিকেটের বিশ্বায়নের আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো যদি ক্রিকেটের আশ্রয়ে চলে আসে তবে ক্রিকেটের যতটুকু অবশিষ্ট আছে, তারও কিছু থাকবে না। ক্রিকেট খেলাটিকে শেষ করতে জুয়ার দুনিয়া আরও বড়ো হবে। একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে তা কখনো চাইতে পারি কি?

 

পরিশেষে, আমি বিশ্বাস করি ক্রিকেট এখনো বেঁচে আছে। ক্রিকেট বেঁচে থাকবে যুগের পর যুগ। আমি বিশ্বাস করি আমাদের ৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো কোনো নাটকের দৃশ্যপট না। আমি বিশ্বাস করি করুনারাত্নে, স্টোকস, মিলাররা যেসব ম্যাচ একা হাতে জিতিয়েছেন, সেগুলো তাদের যোগ্যতা ছিল। কোনো অদৃশ্য সুতোর টানে নয়। আমি বিশ্বাস করি শেষ ওভারের লড়াইয়ে এখনো সবাই জীবন দিয়ে জিততে চায়। হারার জন্য কেউ খেলে না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, ক্রিকেটে এখনো স্বচ্ছতা আছে। ক্রিকেট আবার ফিরবে। অন্ধকার ঠেলে আলোর পথে আসবে। আমাদের আবেগের মর্যাদা দিয়ে সমস্ত অপশক্তিকে হারিয়ে দিয়ে জিতে যাবে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, বিশ্বাস করতে চাই!