(দ্বিতীয় পর্বের পর)
পরদিন সকাল। অমির বেডরুমে বসে আছে সাদ, রিফাত, নিলয়, অমি। সবার মুখ থমথমে। সকাল হতে না হতেই সবাইকে জাগিয়েছে রিফাত। সবাই একসাথে মিলিত হয়েছে। কিভাবে কি করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে। সানজিদাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। ফোন রিসিভ করছে না মেয়েটা। হয়ত খুব মন খারাপ করে কোথাও বসে আছে। ফোন দিতে দিতে ক্লান্ত অমি ও রিফাত। তাও মেয়েটার পাত্তা নেই।
সানজিদা আসলে এমনই। বাকিদের থেকে একটু বেশি আবেগী। অল্পতেই কষ্ট পায়। কয়েকদিন আগে ভার্সিটির এক প্রোগ্রামে এক ভুলের জন্য সিনিয়র এক আপু বকা দিয়েছিল। সে কি কান্না! সে জন্য বন্ধুরা বুঝতে পারছে তার মনের মধ্যে এখন কি চলতে পারে।
‘কি করা যায়?’ নীরবতা ভাঙলো অমি। নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল।
‘জানিনা।‘ আনমনে জবাবটা দিল নিলয়।
‘সাদ, তুই কিছু ভাবলি?’
‘সেই কাল রাত থেকে ভাবছি।‘ জবাব দিল সাদ। ‘কিন্তু কোনো কূল কিনারা পাচ্ছি না।‘
‘সানজিদা যদি ফোনটা ধরতো!‘
‘দেখ কোথায় বসে হয়ত কাঁদছে মেয়েটা। কাল যেভাবে কাঁদছিল।‘
‘কিন্তু আমরা তো বসে থাকতে পারি না।‘ বলল রিফাত।
‘একটা কাজ করা যায় না?’ বলল নিলয়।
‘কি?’ সবাই ফিরল নিলয়ের দিকে।
‘আমরা যেয়ে আঙ্কেলকে বলতে পারি না? বুঝিয়ে বললে হয়ত আঙ্কেল রাজি হতে পারে।‘
‘আমিও কাল থেকে এই একই কথা ভাবছিলাম।‘ বলল সাদ।
‘সেটা কি ঠিক হবে?’ সন্দেহ অমির কন্ঠে। ‘সানজিদা বলেছিল আঙ্কেল নাকি অনেক রাগী। আর একবার যেটা বলেন, কোনো নড়চড় হয় না।‘
‘চেষ্টা তো করে দেখতে পারি।‘ অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে নিলয়।
‘নিলয় ঠিকই বলেছে। এছাড়া কোনো উপায়ও তো নেই।‘ বলল রিফাত।
‘সানজিদার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো,’ বলল সাদ।
‘মেয়েটা তো ফোনই ধরছে না।‘ অমি বলল।
বন্ধুকে নিয়ে তাদের চিন্তার অন্ত নেই। তাদের পাঁচজনের এই গ্রূপ ভার্সিটিতেও খুব বেশি পরিচিত। সবসময় একসাথেচলাফেরা করে, সব কাজে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোনো কিছুতেও এই পাঁচজনকে আলাদা করার উপায় নেই।
হঠাৎ অমির ফোন বেজে উঠল। অন্য ভাবনায় ছিল সবাই। আওয়াজ শুনে চমকে উঠল। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। এক অদ্ভুত রিংটোন সেট করে রেখেছে অমি। সাইরেনের শব্দ, শুনলে অনেকটা এম্বুলেন্সের আওয়াজের মত মনে হয়। কতবার সবাই এই রিংটোন পরিবর্তন করতে বলেছিল, কিন্তু অমি শোনেনি। এই বীভৎস রিংটোনে মাঝে মাঝেই বুক কেঁপে উঠে।
মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল অমি। সানজিদার নাম ভেসে উঠেছে।
‘সানজিদা ফোন করেছে,’ উত্তেজিত হয়ে বলল অমি। খুব দ্রুত ফোন রিসিভ করল। লাউডস্পিকার অন করল যাতে সবাই শুনতে পায়।
‘হ্যালো! কই ছিলি? কতবার ফোন দিয়েছি? তোর কোনো খবর নাই? চিন্তা হয় না আমাদের?’ একগাদা কথা বলে থামল অমি।
‘তোর কথা শেষ হয়েছে?’ বলল সানজিদা। ‘ এক সাথে এত কথা বললে জবাব দিব কি করে?’
‘কি জবাব দিবি তুই?’ বলল নিলয়। ‘কতটা টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম তুই জানিস?’
‘তুই–ও আছিস?’ সানজিদার জিজ্ঞাসা।
‘সবাই আছে,’ বলল অমি। ‘ফোন লাউডস্পিকারে।‘
‘তা, কি হয়েছিল শুনি?’ জিজ্ঞেস করল রিফাত। ‘মরে গিয়েছিলি?
‘নাহ, সেই সৌভাগ্য হয় নাই এখনো।‘ জবাব দিল সানজিদা।
‘ফাজলামি করবি না,’ চিৎকার করে বলল অমি। ‘ফোন রিসিভ করছিলি না কেন সেটা বল।‘
অমি যে রেগে গিয়েছে সেটা বুঝতে পারল সবাই। ও একবার রাগলে সেটা থামানো যায় না বন্ধুরা জানে। ঐদিকে সানজিদাও চুপ। কিছু বলছে না।
‘আমাকে ফোনটা দে।‘ বলল সাদ। সাদের দিকে ফোন বাড়িয়ে ধরল অমি। লাউডস্পিকার বন্ধ করে কানে ধরল সাদ।
‘কি হয়েছিল সানজিদা?’ বলল সাদ। ‘কাল ফোন দিলি, তারপর থেকে তোর খবর নেই। আজ আমরা সবাই মিলে এতবার তোকে ফোন দিলাম। নতুন কোনো সমস্যা হয়েছিল?’
‘না,’ জবাব দিল সানজিদা। ‘তেমন কিছু হয় নি। আসলে কাল তোর সাথে কথা বলার পর মন খুব খারাপ লাগছিল। ছাদে গিয়েছিল। ঐখানে একটা রুম আছে, তুই তো দেখেছিলি। সেখানে ছিলাম। ফোনটা বাসায় ছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। একটু আগে ঘুম থেকে উঠে নীচে নামি। দেখি ফোন বন্ধ, চার্জ শেষ। চার্জ দিয়ে ফোন চালু করে দেখি তোদের এত মিসড কল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম অমিকে।‘ এতটুকু বলে থামল সানজিদা। তারপর জিজ্ঞেস করল। ‘ও কি খুব রেগে গেছে?’
‘তা রাগবে না?’ বলল সাদ। ‘আমারই তো রাগ লাগছিল।‘
‘সরি রে,’ বলল সানজিদা। ‘তোরা কোথায়? আমি আসবো?’
‘আসলে তো ভালো হয়। আমরা অমির বাসায়।‘
‘থাক তোরা, আমি আসছি।‘ ফোন কেটে দিল সাদ। সবাইকে জানাল কি কথা হয়েছে।
‘আজ আসুক। ওর একদিন কি আমার একদিন।‘ মুখ বাঁকিয়ে বলল অমি। কেউ কিছু বলল না।
টিং টং…কলিং বেলের শব্দ হলো।
‘ওই বোধহয় সানজিদা এলো।‘ বলল নিলয়। উঠতে যাচ্ছিল অমি। ওকে থামিয়ে দিল সাদ।
‘তুই বস,’ বলল সাদ। ‘আমি খুলে আসি।‘ সাদ যেয়ে দরজা খুলল। সাথে করে নিয়ে আসলো সানজিদাকে।
‘কি অবস্থা সবার?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল সানজিদা।
একে একে রিফাত, নিলয় জবাব দিলেও অমি জবাব দিল না। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখল।
‘ও খুব রেগে আছে না?’ সাদের কানে কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল সানজিদা।
‘তো, রাগবে না?’ ফিসফিসিয়েই বলল সাদ।
অমির পাশে যেয়ে বসল সানজিদা। ডান কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ‘এমন পেঁচার মত মুখ করে থাকলে তোকে দেখতে একদমই ভালো লাগে না। তোর সুন্দর মুখ জঘন্য লাগে।‘
কটমট করে সানজিদার দিকে তাকালো অমি। যেন চোখের রশ্নিতে ভস্ম করে দিবে। এমন চোখের দিকে তাকাতেও ভয় করে। এমন এক তাকানোর পর ফিক করে হেসে দিল অমি। বলল, ‘আর যদি এমন কিছু করেছিস, আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।‘
যাক, পরিবেশটা শান্ত হয়েছে। অমির রাগও কমে গেছে। আর কোনো চিন্তা নেই। এবার একটাই মাত্র চিন্তা। কি করে সানজিদাকে নিয়ে যাওয়া যায়। নাহলে যে তাদের এবারের ছুটিটা মাটি হবে।
সানজিদা সবাইকে কালকের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছে। সাদকে যা যা বলেছে তাই আবার বলছে। সবাই মুখ বুজে শুনছে।
‘আর কি কোনো উপায় নেই?’ জিজ্ঞেস করল নিলয়।
‘আমি তো কোনো উপায় দেখছি না।‘ জবাব দিল সানজিদা।
‘তাহলে কি আমাদের যাওয়া হবে না?’ রিফাতের প্রশ্ন।
‘তোদের আমি আগেও বলেছি, আবারো বলছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। তোরা ঘুরে আয়। শুধু শুধু আমার জন্য তোদের ছুটিটা মাটি করিস না।’
‘আমরাও তোকে একবার জানিয়ে দিয়েছি,’ বলল অমি। ‘আমরা তোকে নিয়েই যাবো। ‘অমির কথায় সম্মত সবাই। এদিকে সানজিদা সবাইকে বুঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু নাছোড়বান্দা বন্ধুদের কি এত সহজে বুঝানো যায়? মাঝে মাঝে মনে হয় অনেক পুণ্য করলে এমন বন্ধু মেলে।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।‘ হাল ছেড়ে দিয়ে বলল সানজিদা। ‘তাহলে তোদেরকেই ব্যবস্থা করতে হবে।‘
সবাই সাদের দিকে ফিরল। এই বিষয়ে একমাত্র সেই সাহায্য করতে পারে। এ থেকে কেউ উদ্ধার করতে পারলে সাদই পারবে।
‘আমাকে একটু সময় দিতে হবে।‘ সবার চোখের দিকে তাকিয়ে সাদ বলল।
সাদ ভাবছে, কিভাবে কি করা যায়। প্রথমে ভাবল সবাই মিলে সানজিদার বাবাকে গিয়ে রাজি করাবে। সানজিদাকে এই কথা বলতে এক শব্দে ‘না‘ বলে নিষেধ করে দিল। তাহলে কিভাবে কি করা যায়? কিছুতেই মাথায় আসছে না।
‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসছে।‘ হঠাৎ বলল অমি।
সবগুলো চোখ ঘুরে গেল অমির দিকে। সবাই একসাথে প্রশ্ন করল, ‘কি?’
অমি তার মাথায় আসা বুদ্ধির কথা সবাইকে বলছে। তার দৃঢ় ধারণা এটাই একমাত্র উপায়। সে উপায় শুনে বাকিরা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। সানজিদার চোখ চকচক করে উঠল, নতুন এক রোমাঞ্চের অভিযানে। কিন্তু শুরুতেই অমির এই চিন্তায় ‘না‘ আরোপ করে দিয়েছে।
‘তাহলে তুই বল কি করা যায়?’ সাদকে প্রশ্ন করল অমি। সাদ চুপ। এখনো কিছু ভাবনা চিন্তা কাজ করছে না, কি বলবে?
‘সাদ ঠিকই বলেছে,’ বলল নিলয়। ‘ব্যাপারটা খুব রিস্কি।‘ নিলয়কে সম্মত জানালো রিফাত।
‘আর কি কোনো উপায় আছে তোদের কাছে?’ জিজ্ঞেস করল অমি। সবাই নীরব। ‘যখন কোনো উপায়ই নাই, এটাই চেষ্টা করা যেতে পারে।‘ আবার বলল অমি। যাকে নিয়ে এত পরিকল্পনা তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি বলিস, সানজিদা।‘
কি যেন ভাবছিল দীপ্তি। ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এসে দীপ্তি বলল, ‘আবার তো বেশ লেগেছে বুদ্ধিটা । কেমন একটা রোমাঞ্চকর এডভেঞ্চার এডভেঞ্চার ভাব।‘
‘তাহলে তো হয়েই গেল,’ বলল রিফাত। ‘যাকে নিয়ে এত পরিকল্পনা, সে যখন রাজি তো আমাদের আর কি বলার থাকতে পারে?’
‘তুই কিছু বলছিস না যে সাদ?’ জিজ্ঞেস করল নিলয়।
‘আমার বিষয়টা পছন্দ হচ্ছে না।‘ জানিয়ে দিল সাদ। তারপর বলল, ‘তোরা যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিস, আমার আর কিছু বলার নেই। সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত আমি। তবে খুব সাবধান, প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবে চিন্তে ফেলতে হবে।‘
সাদের সম্মতি পাওয়া গেছে। আর কি লাগে? পুরো পরিকল্পনা এখন সাদের উপর। ওই ঠিক করবে কিভাবে কি করা যায়। সে নিয়েই আলোচনা চলছে।
চলবে……
পেপারস লাইফ/গল্প/সাকিব আহমেদ
পড়ুন : ছুটির দিনে (পর্ব ২)