ভেসে বেড়ানো জীবনের ঠাঁই নেই কোথাও | বইয়ের রিভিউ


ভেসে বেড়ানো জীবনের ঠাঁই নেই কোথাও | বইয়ের রিভিউ


বই : বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ

লেখক : শরীফুল হাসান 

রিভিউ লিখেছেন : সাকিব আহমেদ 

 

১৯৭১ সাল! মুক্তিযুদ্ধ! এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের জীবনে অনেক অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। এই মুক্তিযুদ্ধের ফলে আমরা পেয়েছি স্বাধীন ভূখণ্ড। পেয়েছি একটি মানচিত্র আর লাল-সবুজের পতাকা। হারিয়েছি বর্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে। বিজয় ছিনিয়ে এনেছি বীরের বেশে। এই বিজয়ের পেছনে কিছু গল্প থাকে। এই গল্পগুলো কখনো আনন্দের, কখনোবা তীব্র বেদনার। এই বিজয়ের গল্প লেখার পেছনে কত রক্ত ঝরেছে, তার খবর কেউ রাখে না। কত মানুষ হারিয়ে গিয়েছে, তার কথা কেউ জানে না। যুদ্ধ কেবল বিজয়ের কথাই জানে, বিজয়ের গল্পই লেখে। ইতিহাস লেখা হয় জয়ীদের দ্বারা। যারা হেরে যায়, কিংবা হারিয়ে যায় তাদের কথা কয়জনই বা জানতে চায়? দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানুষ যেমন তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে, হারিয়েছে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইও। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পাড়ি জমিয়েছে ওপারের শরণার্থী শিবিরে। যুদ্ধ শেষে আবার ফিরেও এসেছিল প্রিয় জন্মভূমি টানে। কিন্তু কিছু মানুষ তো ফিরতেও পারেনি। হয় মৃত্যুর ভয়াল থাবায় হারিয়ে গেছে, নয়তো গভীর রাতের মতো তীব্র অন্ধকারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। তাদের গল্প কেউ জানতে চায় না। তারা যেন উদ্বাস্তু। বিজয়ের গল্পে এক অনর্থক বস্তু। তবুও তাদের গল্প লিখতে হয়। কাউকে না কাউকে লেখার দায়িত্ব নিতে হয়। জীবনের গল্পে তারা কোথায় হারালো জানতে হয়, জানাতে হয়।

জীবন! আহা জীবন! এই জীবন এক অদ্ভুত জিনিস। যেখানে মানুষের ভালো থাকার আকুতি, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা সব মিলেমিশে এক হয়ে যায়। তবুও কি মানুষ ভালো থাকে? হয়ত থাকে। কিংবা অভিনয় করে। জীবন যুদ্ধে লড়াই চলে। সেই লড়াইয়ে কেউ জেতে, কেউ হেরে যায়। অনেকে আবার জীবনের থেকে পালিয়ে বেড়াতে ব্যস্ত। কতটা পথ পেরিয়ে একটু ভালো থাকার চেষ্টা করে। সবসময় কি পারে? কখনো খড়কুটোর মতো ভেসে চলে যেতে হয় দূর বহুদূর। সেখানে একটু থিতু হওয়ার চেষ্টা। কিন্তু, যার জীবন নদীর স্বচ্ছ জলে কচুরিপানার মতো ভেসে চলতে শিখে গেছে, সে কি স্থির হতে পারবে? জীবন কোনো বাঁধ মানে না। জীবন ছুটে চলে আপন গতিতে, কখনও তীব্র গতিতে দৌড়ায়। অসীমের পথে, অজানার পথে।

কাহিনি সংক্ষেপ :

তার নাম পিন্টু। আবার আলবার্ট পিন্টো কিংবা গৌরহরি সাহা। তার প্রকৃত পরিচয়, সে মানুষ। তার কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই। সে আলাদা। সবার চেয়ে আলাদা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাবা-মায়ের সাথে বাংলাদেশ থেকে ভারতের শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই পেয়েছিল। কিন্তু নিয়তি খারাপ থাকলে যা হয়! বাবা-মা দুইজনকে হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়ে। বড়ো এক ভাই ছিল, সেও পালিয়ে গেল তার মতো চার-পাঁচ বছরের শিশুকে একা রেখে। অনাথ, অসহায় হয়ে যাওয়া পিন্টুর নতুন ঠিকানা ভারতের একটি চার্চ। পিন্টু থেকে হয়ে উঠল আলবার্ট পিন্টো। সেখানেও স্থায়ী হতে পারল না। একটা সময় সেখান থেকেও ছুটে চলা। শিকড়ের টানে হোক বা অন্য কোনো কারণে, আবারও সেই বাংলাদেশে ফিরে আসা। লক্ষ্য, নিজের পরিচয় বের করা। চাইলেই কি তা সহজে করা যায়? যেই দেশের মাটিতে প্রথম পা রাখল, সেখানে আট-নয় বছরের শিশু কীভাবে খুঁজে পাবে তার বংশ পরিচয়? সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল। বাংলাদেশে এসে পরিচয় বদলে, ধর্ম বদলে হয়ে উঠল এক নতুন মানুষ। নাম তার গৌরহরি সাহা। নতুন এ জীবন বেশ আপন করে নিয়েছে সে। নতুন পরিবেশে বেশ কিছু প্রিয় মানুষের সানিধ্য পেয়েছে। যাদের খুব কাছের মানুষ মনে হয়। যারা খুব ভালোবাসে তাকে। তাদের ঋণ শোধ করবে কীভাবে ভেবে পায় না। কিন্তু ভেসে যাওয়া জীবন নিয়ে কত কী আর করা যায়! এই এখানে তো ওই সেখানে। এভাবেই তো চলল এতগুলো বছর। তাই এবারও হারিয়ে যাওয়া। বিশাল এই জীবন নামক সমুদ্রে মাঝিবিহিন নৌকার মতো এবার তাকে কোথায় যেতে হবে, কে জানে?

দু’চোখ জুড়ে স্বপ্ন নিয়ে মেয়েটা বড়ো হচ্ছে। এই স্বপ্ন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। নিজেকে সবার উপরে দেখতে চাওয়ার। পূরবী চায় ডাক্তার হতে। গায়ে অ্যাপ্রন জড়িয়ে, স্টেথোস্কোপ হাতে নিয়ে সে যখন বাবার সামনে দাঁড়াবে, বাবা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন। স্কুল জীবন থেকেই তাই পড়াশোনায় মনোযোগী পূরবী। বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়ে যাচ্ছে। এই সময়টা একটি মেয়ের পরিবর্তনের সময়। পূরবীরও পরিবর্তন হচ্ছে। মানসিক পরিবর্তন। সে এখন স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নের ডানায় ভেসে বেড়াতে চায়। চায় এমন একজন পাশে থাকুক, যাকে মন খুলে সব বলতে পারবে। ভালোবেসে কাঁধে মাথা রেখে নির্ভার থাকতে পারবে। এমন কেউ কি আছে? কাউকে ভালো লাগে পূরবীর? হতে পারে। সেই ভালো লাগা কি ভালোবাসা? পূরবী জানে না। শুধু জানে, সেই স্বপ্নের মানুষকে সে চোখে হারায়। বারবার দেখতে চায়। পাশে থাকতে চায়। অনুভব করতে চায়। কিন্তু সব স্বপ্ন যে পূরণ হয় না। স্বপ্ন তো থাকেই ভাঙার জন্য। পূরবীর স্বপ্ন একদিন ভেঙে গেল। সেই ভেঙে যাওয়া মনে ঝড় উঠেছে। কালো মেঘের আনাগোনা চারিদিক। পূরবীর চারিপাশ কেমন যেন অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে। সেই অন্ধকার আরও কালো করে আসছে অভিশাপ, সেলিম খান। এই অভিশাপ থেকে বাঁচবে কী করে? কে বাঁচাবে তাকে?

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে লাশ পাওয়া গেছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে জ্বলজ্যান্ত মানুষকে। কে মারল এভাবে? এমন নির্দয় নির্মমভাবে কেউ কাউকে মারে? লাশের পকেটে পাওয়া গেল ছোট্ট একটি চিরকুট। এই রহস্য উদঘাটন করতে চাইছে ওসি আমিন উদ্দিন। কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। সামান্যতম সূত্র নেই। এভাবেই চলে গেল কয়েকটা মাস। কেসের মীমাংসা হয়নি। দেখতে দেখতে ওসি আমিন উদ্দিনের অবসরের সময় চলে এলো। বিদায় সংবর্ধনার দিন আবু জামসেদকে দিয়ে গেলেন চ্যালেঞ্জ। যে করেই হোক, এই কেস সলভ করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে পুড়ে যাওয়া সেই ব্যক্তিটিকে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন আবু জামসেদ। তদন্ত শুরু করলেন। যতটা না চ্যালেঞ্জের জন্য, তার চেয়েও বেশি নিজের স্বস্তির জন্য। খোঁজ নিতে গিয়ে আবু জামসেদ জানতে পারলেন, এর শিকড় লুকিয়ে আছে পুরনো এক কেসে। আবু জামসেদের ধারণা সে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। সত্যিটা কি ধরা দিবে এবার? না-কি অমীমাংসিত থেকে যাবে এই রহস্য?

পূরবী, না সুস্মিতা? কে বেশি সত্যি? গৌরহরি ভাবে তার জীবনের লক্ষ্য কী! এভাবে ভেসে বেড়ানো জীবন নিয়ে কার কাছে ঠাঁই পাবে? একটু ভালো থাকার আশায়, ভালোবাসা পাওয়ার আশায় এ পথ থেকে ও পথে ছুটে যাওয়া। কার ভালোবাসায় জীবন থামবে এবার, সে জানে না। যে গল্পের শুরু হয়েছিল বৃষ্টিতে, বৃষ্টিতেই যেন তার পরিসমাপ্তি। মুষলধারে ঝরে পড়া বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে সব আবেগ, গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে বিষাদের সুর। এক সময় বৃষ্টি থামে। সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রেখে যায় কেবল বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ।

পাঠ প্রতিক্রিয়া :

উপন্যাসটি কেমন লাগল তা জানানোর আগে লেখক শরীফুল হাসানকে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই, এমন এক উপন্যাস আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। পাঠ প্রতিক্রিয়ায় কী জানাবো সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। উপন্যাসটি শেষে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। অনেকদিন পর তৃপ্তি নিয়ে একটি বই শেষ করলাম। যার রেশ দীর্ঘক্ষণ মাথার মধ্যে ছিল। এর অবদান পুরোপুরি লেখকের। এত সুন্দর করে সব সাজিয়েছেন, যা সত্যিই মনে ধরার মতো। বিশেষ করে চরিত্র। সবগুলো চরিত্রকে মনে হয়েছে খুব আপন। খুব প্রিয়।

উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে লেখকের অসহায়বোধ হচ্ছিল। এছাড়া আনন্দ, হতাশা, বিষণ্ণতা, রাগ-ক্ষোভ সব এক হয়ে গিয়েছিল। আমিও ঠিক একই অনুভূতিগুলো অনুভব করছিলাম। সেই সাথে যোগ হয়েছিল অভিমান ও আক্ষেপ। এই অভিমান কার প্রতি, বা আক্ষেপ কীসের প্রতি জানা নেই। হয়ত সমাজের প্রতি। কিংবা জীবনের প্রতি। যে জীবন ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। যে সমাজ বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছাটাও মেরে ফেলে। সেই সমাজ বা জীবনের প্রতি আক্ষেপ, অভিমান দেখানো অযৌক্তিক?

এছাড়া সম্পর্কের বন্ধন কিংবা টানাপোড়েন ভালো মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। আমি আগে থেকেই লেখকের বর্ণনার অনেক বড়ো ভক্ত। তার বর্ণনাগুলো পড়লে মনে হয়, যেন চোখের সামনে সবকিছু ভেসে উঠছে। এই বইতেও তেমন অনুভূতি ছিল। বর্ণনাগুলো আরও পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। লেখকের শব্দচয়নে পরিপক্কতা লক্ষ্য করেছি। আরেকটা বিষয় ভালো লেগেছে, লেখকের ইংরেজি শব্দ ব্যবহার কম করে পারিভাষিক শব্দের ব্যবহার করেছেন। একটা উদাহরণ দেই, এয়ার কন্ডিশন বা এসি-কে নব্বই শতাংশ লেখক-ই এসি লিখবেন। কিন্তু এখানে লেখক শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র লিখেছেন। ব্যাপারটা বেশ ভালো লেগেছে। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে লেখকদের যথাসম্ভব বাংলা অক্ষরে ইংরেজি শব্দের আধিক্য পরিহার করা উচিত বলে আমার মনে হয়। এতে সাহিত্যের মান বজায় থাকে। তবে অনেক ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত। সেগুলোর বিষয় আলাদা। তবে কিছু ক্ষেত্রে যেসকল শব্দের প্রচলিত পারিভাষিক শব্দ রয়েছে, সেগুলো কেন ইংরেজিতে লিখতে হবে তা বোধগম্য হয় না। অন্যের অবস্থা জানি না, আমার অত্যন্ত বিরক্ত বোধ হয়।

বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ উপন্যাসটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল টাইমলাইন। বিভিন্ন সালের গল্প বিভিন্নভাবে এগিয়েছে। শেষে এক সুতোয় মিলেছে। এখানে লেখককে সাধুবাদ দিতেই হয়। প্রতিটি অধ্যায় শুরুর পূর্বে অধ্যায়ের নামগুলো ভালো লেগেছে। পাঠক শুরুতে অধ্যায়ের নাম পড়বে, গল্প কেমন হতে পারে তা অনুভব করবে, এরপর গল্পের ভেতর প্রবেশ করবে। অন্তত আমি সেভাবেই পড়েছি। আর এভাবে উপন্যাসটি আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল।

বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ একটি সামাজিক উপন্যাস। এখানে সমাজের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৮ সালের গল্প। কেমন ছিল, সে সময়ের বাংলাদেশ? তা ফুটিয়ে তুলতে সাধ্য মতো চেষ্টা করেছেন লেখক। সেই সময়ের উত্তল রাজনীতির দিকটিও তুলে এনেছেন লেখক। বিশাল কলেবরের উপন্যাসে সমস্যা যেটা হয়, তা হচ্ছে টেনে লম্বা করা বা অপ্রাসঙ্গিক কিছু রচনা। উপন্যাসে তেমন কিছু লক্ষ্য করিনি। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই বর্ণনা করা হয়েছে।

এই বইয়ে আমার অসংখ্য প্রিয় বাক্য আছে, সেগুলো আলাদা করে দিলাম না। পাঠক বইটি পড়ে প্রিয় লাইনগুলো খুঁজে বের করবে।

গল্পবুনন ও চরিত্রায়ন :

বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইনে রচিত একটি উপন্যাস। যার শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। কখনো ১৯৯০ এ গিয়ে লেখক গল্প করেছেন, আবার ১৯৯৫ এর দৃশ্যপট তুলে এনেছেন। বিভিন্ন টাইমলাইনে গল্প এগুলেও, সবকিছুকে লেখক খুব সাবলীলভাবে এক সুতোয় বেঁধেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের সাল ভিন্ন ছিল, ভিন্ন ছিল গল্পগুলো। সবগুলো অধ্যায়ের শুরুতে নামগুলো বেশ মনে ধরেছে। এতে ভাবনার এক জগৎ তৈরি হয়েছে। যে জগতে পূর্বে পাঠকের ও পরে গল্পের প্রবেশ ঘটেছে।

লেখকের লিখনপদ্ধতি বেশ সাবলীল। বাচনভঙ্গি কিংবা বর্ণনা খুব সহজেই পাঠককে আকৃষ্ট করে। থ্রিলার উপন্যাস না হয়েও বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ যেভাবে আকৃষ্ট করেছিল, তার জন্য লেখক সাধুবাদ পেতেই পারেন। লেখক সংলাপ বলার চেয়ে গল্প বলার দিকে বেশ মনোযোগ দিয়েছেন।

গল্পের চরিত্রগুলো নিয়ে বিশেষ কিছু বলা প্রয়োজন। বিশাল এই উপন্যাসে নানান সময় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র এসেছে। সবগুলোই স্বতন্ত্র, প্রয়োজনীয়। কিছু কিছু চরিত্র যেমন অপরিহার্য, আবার কেউ কেউ গল্পের প্রয়োজন মিটিয়ে হারিয়ে গিয়েছে। পিন্টু, আলবার্ট পিন্টো বা গৌরহরি এই গল্পের প্রধান আকর্ষণ। ছোটো থেকে বড়ো হওয়া, জীবনের অনেকগুলো দিক দেখতে পাওয়া পিন্টু বড়ো হতে হতে বুঝতে শিখেছে জীবনকে।

সুস্মিতা কিংবা পূরবী মেয়ে দুটো আলাদা হলেও কোথাও যেন এক। আবার অনেকখানি আলাদা। দুজনেই ভালোবাসতে জানে, দুজনেই বড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখে। দুজনেই নিজেদের স্বল্প পূরণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু অন্যদিকে আবার আলাদা। সুস্মিতা যেমন অনেক চঞ্চল, ডানপিটে; অন্যদিকে পূরবী শান্ত ধীরস্থির।

বিশ্বনাথ, বিষ্ণু, রাঙা মা, ওসি আমিন উদ্দিন, সেলিম খান, আবু জামসেদ প্রমুখ সবাই ভিন্ন মানুষ। ভিন্ন তাদের চরিত্র। প্রত্যেকেই সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। সবকিছু ছাপিয়ে আমার পূরবী চরিত্রটা বেশ মনে ধরেছে। এমন এক মেয়ে, সব প্রতিবন্ধকতা, বাঁধা পেরিয়ে নিজের লক্ষ্যে গিয়ে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে সচেষ্ট।

বানান ও সম্পাদনা :

এই বিষয় নিয়ে আসলে বেশি কিছু বলার নেই। প্রকাশনা জগতে সম্পাদনা আর প্রুফ রিডিংয়ে কেন এত উদাসীনতা সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। বানান ভুলের আধিক্য প্রচুর না থাকলেও বেশ কিছু ছিল। যা বইয়ের মন কমিয়ে দিতে যথেষ্ট। কিছু জায়গায় বাক্য গঠনে সমস্যা লক্ষ্য করেছি। কি/কী এর ভুল ব্যবহার ছিল বেশ কয়েক জায়গায়। একটা জায়গায় লক্ষ্য করেছি সুপর্ণাকে গৌরহরির ভাবী হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু হিন্দু পরিবারে তা বৌদি হওয়ার কথা। যদিও পরবর্তীতে শুধরে নেওয়া হয়েছে।

এগুলোর জন্য আমি লেখককে দোষ দিতে নারাজ। এত বড়ো উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে লেখক একটু আধটু ভুল করতেই পারেন। সেগুলো ঠিক করার দায়িত্ব প্রকাশনীর। কিন্তু আমাদের প্রকাশনীগুলো সেটা করবে না। চমকপ্রদ প্রচ্ছদ, দুর্দান্ত বাইন্ডিংস, বেস্ট প্রোডাকশনের নাম ভাঙিয়ে প্রকাশনীগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই নজর দেয় না। সম্পাদনা আর প্রুফ রিডিং। ফলে ভালো বইগুলোর গুণগত মান কমে যায়।

প্রচ্ছদ ও প্রোডাকশন :

বইয়ের প্রচ্ছদ অনেক সুন্দর। বৃষ্টির দিনে ঝোড়ো হাওয়া যেমন সবকিছু ওলট পালট করে দেয়, প্রচ্ছদে তেমন আবহ আছে। নামলিপিও বেশ। সাধারণ, তবুও অসাধারণ। বইয়ের বাঁধাই চমৎকার ছিল। বিশাল কলেবরের এই উপন্যাস পড়তে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। পৃষ্ঠা যেমন খুলে আসেনি, তেমনই বই খুলে আরামে পড়া গিয়েছে।

পরিশেষে, লেখক শরীফুল হাসানের সাম্ভালা বাংলা সাহিত্যে এক মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। অনেকের কাছে তাঁর সেরা কাজ ছায়া সময়। আমার বিশেষ পছন্দের উপন্যাস যেখানে রোদেরা ঘুমায়। এই তালিকায় এখন বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণও যুক্ত হলো। এই বইটি সবার পড়া উচিত। লেখকের ভিন্ন কাজ, ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা উপন্যাসটি নিয়ে মতামত জানানো উচিত। আশাকরি উপন্যাসটির সাথে সময় খারাপ কাটবে না।