স্ট্রাইকার | মতি নন্দী | বই রিভিউ


স্ট্রাইকার | মতি নন্দী | বই রিভিউ


“স্ট্রাইকার! স্ট্রাইকার! তোমার সামনে দুর্ভেদ্য ডিফেনস। ভাঙতে কি পারবে না?”

স্ট্রাইকার কথাটির সাথে ফুটবলের কিন্তু একটা যোগসাজশ রয়েছে এটা সবাই জানে। ফুটবলে স্ট্রাইকারের কাজ হচ্ছে সবাইকে পাশ কাটিয়ে, দুর্ভেদ্য ডিফেনস ভেদ করে গোল দেয়া। স্ট্রাইকারকে একসাথে কাটাতে হয় অনেক অনেক বাঁধা।

এতো গেল ফুটবলের কথা। ফুটবল বাঙালির জীবনে একটা সবসময়ই উৎসবের অংশ। পাড়ার মোড়ে ছোট্ট বল নিয়ে হোক আর বিশাল স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শক নিয়ে আয়োজন হোক, ফুটবলের আমেজ কিন্তু একই রকম রয়েছে সবখানে। ফুটবল কারো কাছে উৎসব, কারো কাছে মান সম্মানের লড়াই আবার কেউ কেউ বেঁচে থাকে ফুটবলের জন্য, নিজের স্বপ্নের জন্য। ফুটবলের এই উন্মাদনার জন্য বোধহয় উত্তম কুমারের সেই বিখ্যাত ছবি “ধন্যি মেয়ে” তে মান্না দে গেয়েছিলেন,

             “সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল”

ফুটবলের সেই স্ট্রাইকারের কাছে আবার ফিরে আসা যাক বরং। গল্পটা মতি নন্দীর লেখায় ফুটে উঠেছে যেন জীবন্ত হয়ে। এই গল্পটা এক স্ট্রাইকের গল্প। যাকে খেলার মাঠে যেমন বল নিয়ে ছুটতে হয় গোলের দিকে, তেমনি জীবনের যুদ্ধেও সে স্ট্রাইকার। তাঁকে লড়াই করে এগিয়ে যেতে হয় নিজের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। এই গল্পটা প্রসূনের, এই গল্পটা এক স্ট্রাইকারের। এই গল্পটা এক বাবার। এই গল্পটা খেলোয়াড়ি জীবনের।

 

   ~প্রসূন, দ্য স্ট্রাইকার~

অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরি, যেখানে লক আউট চলছে বাবা বেকার! বাবা এখন দোকানে সামান্য একটা কাজ করেন, যা পান তাতে দু’বেলা কয়েকটা রুটি ছাড়া আর কিছু আর জোটে না।

ভাই পিন্টু বুঝতে শিখেছে ওঁরা দরিদ্র, ওঁর হাবভাবে এখনই যেন কেমন বুড়োটে ছাপ পড়ে গেছে। বায়না, আবদার বা অভিমান কী রাগারাগি একদম করে না, গম্ভীর হয়ে শুকনো মুখে বেরিয়ে যায়। শুধু কান্নাকাটি জুড়ে দেয় বোন পুতুলটা। তখন নীলিমা ওকে টেনে নিয়ে যায় নিজেদের ঘরে। কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় পুতুল খেলা করছে। নীলিমার মা দু’ বছর আগে মারা গেছেন। সেই থেকে সে সংসারের কর্ত্রী। বাবা টাকা এনে ওর হাতে দেয়, নীলিমা গুছিয়ে হিসাব মতো খরচ করে। নীলিমা হলো প্রসূনদের পাশের ঘরেরই ভাড়াটে নুটু’দার মেয়ে।

রাগটা শেষ পর্যন্ত নিজের উপরই এসে পড়ে প্রসূনের। বড় ছেলে হয়ে সংসারে একটা টাকাও দিতে পারে না সে। অথচ ফুটবল খেলার স্বপ্নটা এখনো কেনো ছাড়তে পারে না সে? কেনো তাঁর জীবনের সমস্ত কিছু জড়িয়ে আছে ওই ফুটবল নিয়ে? ফুটবল কী দিতে পেরেছে তাঁকে?

প্রসূনকে মা বুকে চেপে ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। তারপর বললেন, ”খোকা, মন দিয়ে চেষ্টা করবি।” কিট ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে যখন বটতলার দিকে যাচ্ছে প্রসূন, তখন মনের মধ্যে মা’র কথাটাই গুনগুন করছিল সে। মন দিয়ে কেন, প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করবে, মা সারা জীবন কষ্টে কাটিয়েছেন, তাঁকে সুখী করবেই প্রসূন। ফুটবলাররা চাকরি পায়, ক্লাব থেকে টাকাও পায়। প্রসূন জানে শোভাবাজার ইউনিয়ন টাকা দেবে না, দেবার সামর্থ্যও নেই। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা যুগের যাত্রীর মতো বড় ক্লাবে যেতেই হবে প্রসূনকে। যাবার প্রথম ধাপ শোভাবাজার। এক কী দু’বছরের মধ্যে চোখে পড়াতেই হবে নিজের খেলা। খেলা দেখিয়েই বড় ক্লাবে যেতে চায়, তার পর একদিন ইন্ডিয়ার জার্সিও পরবে। টাকা আর খ্যাতি দুটোই প্রসূনের চাই, তবে এখন দরকার শেষেরটা।

বন্ধু নিমাই আর আনোয়ার বটতলায় দাঁড়িয়ে। ওরাও যাচ্ছে একসাথে শোভাবাজার ক্লাবে ট্রায়াল দিতে। যদি ওদের ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে শোভাবাজার ক্লাবে ঠিক সুযোগ হয়ে যাবে। এবং সত্যিই ওদের জায়গা হয়ে গেল শোভাবাজার টিমে, কোচ বিপিনদা প্রসূনের পজিশন দিলেন “স্ট্রাইকার”। সন্ধ্যায় হর্ষদার বাড়ি গেল প্রসূন, যার সূত্র ধরেই ও শোভাবাজার ক্লাবে গিয়েছিল ট্রায়াল দিতে। সব শুনে হর্ষদা বললেন, ”আরে বিপিন সিংহী যা করতে বলে, করে যাবি। যা গল্প বলবে, শুনে যাবি। ওর কাছে তো খেলা শেখার জন্য তুই যাসনি। গেছিস একটা ফার্স্ট ডিভিশন টিমে ঢুকে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, এরিয়ান কি যুগের যাত্রীর চোখে পড়তে। সে জন্য একটা ক্লাব তো দরকার। শোভাবাজার না হলে তোর মতো অজানা অনামী একটা জুনিয়ারকে চান্স দেবে কে? স্পোর্টিং ইউনিয়ন কি জর্জ টেলিগ্রাফে গেলেও তো পাত্তা পাবি না।”

হর্ষদার কথায় প্রসূন সেটাই ভাবে, এবং শোভাবাজারে কয়েকটা ম্যাচ খেলেও ফেলে। কিন্তু প্রসূনের কোথাও যেন একটা অপ্রাপ্তি থেকে যায়। সে নিজের খেলাটাকে আরেকটু উন্নত করতে চায়। সে চায় কোন বড় টিমে খেলে নিজের খেলার স্কিলটাকে আরেকটু উন্নত করতে। মোহনবাগান, মোহামেডান, যুগের যাত্রী এসব বড় টিমে না খেললে নিজের খেলাটাকে প্রসূন চিনবে কি করে? সে আরো অনেক কিছু শিখতে চায়, জানতে চায় তার জন্য চাই বড় দল। বিপিনদা অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন প্রসূনের উদ্দেশ্য, তাই তিনি বলেছিলেন একটা বছর শোভাবাজারেই থেকে যেতে পরের বছর থেকে না হয় প্রসূনদের কিছু কিছু টাকাও দেবেন।

প্রসূন সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খায়। পরে নিলীমা আর হর্ষদার কথায় সে শোভাবাজারে আর থাকে না। বড় কোনো দলের জন্য চেষ্টা করতে চায়। দুই বন্ধু আনোয়ার আর নিমাই অবশ্য শোভাবাজারেই থেকে যায় বিপিনদার প্রলোভনে। আর প্রসূনের নেমে আসে অমোঘ নিয়তি। সংসারের হাল ধরতে চাকরি নিতে হয় গ্যারেজে। ফুটবল প্রাকটিস শিকেয় উঠলো অনেকটাই। একদিন ঠাটবাট দেখানো দুই বন্ধুর সাথে হয়। ওঁরা ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে বিমানে চড়ে, সাথে বিপিনদাও আছেন। সবাই বেশ বিদ্রুপই করলো প্রসূনকে। কিন্তু প্রসূন দমে গেল না।‌ যে স্ট্রাইকার, সে তাঁর গোলের দিকে এগিয়ে যাবেই।

বাবা সবসময় বলতেন এই ফুটবল তাঁর জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রসূনের বাবা যুগের যাত্রী দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন প্রায় সাত বছর কিন্তু পরবর্তীতে দল তাঁকে দাম দেয় নি। এখন বেকার অনেকটা ঘরে বসা অবস্থা তাঁর। ফুটবল খেলাকে তাই বাবা কখনো উৎসাহ দিতে পারেনি এটা নিয়ে বড্ড অভিমান প্রসূনের। শোভাবাজারেরই এক ছেলে রতনের মাধ্যমে প্রসূন নতুন একটা দলে যোগ দেয় নাম “সোনালী সংঘ”। এখানে পরিচয় হয় বিশুদার সাথে। প্রসূনের খেলোয়াড়ি জীবনের আবার শুরু হয়। দল কিছু টাকাও দেয় তাঁকে।

এরপর শোভাবাজারের সাথে খেলার দিন প্রসূনের জন্য অদ্ভুত টান দেখা যায় পুরনো বন্ধু আনোয়ার আর নিমাইয়ের। শোভাবাজারের পলাশ টিকাদার প্রসূনকে বাজেভাবে ফাউল করে, আনোয়ার মাঠেই পলাশকে মারে। দুই বন্ধু বিপক্ষ দল শোভাবাজারের হলেও তাঁকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায় বাড়ি এসে।

প্রসূনের খেলোয়াড়ি জীবনে সাফল্য বেশ। তাতে আবার সে পায় ঘুষের প্রস্তাব। ইচ্ছে করে গোল না করা বা সেই ম্যাচ না খেলার প্রস্তাব। সেই ম্যাচটা ছিলো যুগের যাত্রীর সাথে।‌ তাঁর বাবার ক্লাব! বাবার অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ! প্রসূন ঘুষের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে প্রাণপণ লড়াই করে যুগের যাত্রীকে হারাবার। কিন্তু না এবার সে ব্যর্থ।

কিন্তু তাঁর জন্য আরো একটা বিষ্ময় অপেক্ষা করছিলো যখন সে যুগের যাত্রী দলের হয়ে খেলার প্রস্তাব পায়! কী সিদ্ধান্ত নেবে প্রসূন? তাঁকে নিতে হবে বাবার অপমানের প্রতিশোধ। গর্বিত করতে হবে বাবাকে ফুটবল দিয়ে। কিন্তু সেটা কীভাবে? এই গল্পটা এক স্ট্রাইকারের, এক বাবার।

 

   ~স্ট্রাইকার নিয়ে মনের কথা ~

মতি নন্দীর লেখার সাথে আমার পরিচয়টা একটা দেরি করেই। এমনিতে জানতাম ওনার লেখনী কিংবা ওনার জীবন সম্পর্কে। কিন্তু ওনার লেখার স্টাইল কিংবা ওনার গল্প বলার ধরণ নিয়ে ধারণা একদমই ছিলো না।

মতি নন্দীর “বুড়ো ঘোড়া” পড়েছিলাম। এবার পড়লাম “স্ট্রাইকার” মানে কী বলবো বলা যায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম এই লেখকের লেখনীতে। এত সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প বলা যায়!

এই বই যতটা না কিশোর উপন্যাস, এই বই ততটাই মোটিভেশনাল লেগেছে আমার। আমি বোধহয় কিছু শিখতে পেরেছি, আমি বোধহয় চোখের সামনে দেখতে পেরেছি প্রসূনের লড়াই, এক স্ট্রাইকারের লড়াই।

এই জীবনে আরাম আয়েশে যারা কাটায় আর বড় বড় বুলি আউড়ে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করে, তার থেকে বাস্তব জীবনের এমন একেকটা প্রসূন, একেকটা স্ট্রাইকার আমাকে মুগ্ধ করে। এটা শুধুমাত্র বইয়ের গল্প নয়। বাস্তবে ছড়িয়ে আছে এমন হাজারো প্রসূন। যাদের জীবনের গল্প আমাদের অজানা।

আমরা কীসের বড়াই করি বলুন তো? নিজের যোগ্যতার সিলমোহর শুধু বড় বড় বুলি আউড়ে জাহির করি। কিন্তু জীবনের যুদ্ধে স্ট্রাইকার থামে না। তাঁরা থামতে জানে না। খেলার মাঠেও ডিফেনস ভেঙে গোলপোস্টে ঠিক গোল দিয়ে দেয়। স্ট্রাইকার! স্ট্রাইকার! তোমরা থেমে যেও না!

বইয়ের নাম: “স্ট্রাইকার”

লেখক: মতি নন্দী

ব্যক্তিগত রেটিং: ৫/৫

 

পেপারস লাইফ/বই রিভিউ/ফারজানা তাজরী/