বুয়েট ছাত্র ফারদিন নিহতের ঘটনায় তদন্তে পাওয়া তথ্যপ্রমাণ নিয়ে সন্দেহ নেই বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকেলে বুয়েট শহীদ মিনারের পাশে সাংবাদিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন শিক্ষার্থীরা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বুয়েটের ৩১ শিক্ষার্থী ডিবি কার্যালয় ও ২১ শিক্ষার্থী গত শুক্রবার র্যাব সদর দপ্তরে যান।
আজ শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পর থেকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি আমরা পালন করে আসছিলাম। ডিবি ও র্যাব থেকে ব্যাখ্যা পাওয়ার পর আমরা নতুন কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছি না। তবে ফারদিনের পরিবারের যেকোনো যৌক্তিক দাবির পক্ষে আমরা থাকব।’
আরও পড়ুন:
আওয়ামী লীগ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ করেছে : শেখ হাসিনা
গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের একটি দল ডিবি কার্যালয়ে তদন্তের তথ্য প্রণালি দেখার জন্য যান। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিবির তদন্তের প্রচেষ্টায় আমরা সন্তুষ্ট। তবে কিছু গ্যাপ রয়েছে সেই গ্যাপগুলো পরিষ্কার করার দাবি জানাই।’
গতকাল শুক্রবার র্যাব সদর দপ্তরে যান শিক্ষার্থীরা। প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন। এরপর আজ শনিবার বুয়েট ক্যাম্পাসে এসে শিক্ষার্থীদের বিষয়গুলো জানান। পরে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান জানালেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা বলে গত ৪ নভেম্বর ডেমরার কোনাপাড়ার বাসা থেকে বের হন ফারদিন। ৭ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। গত বুধবার র্যাব ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দাবি করে, ফারদিনকে হত্যা করা হয়নি। তিনি ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ডিবি পারিবারিক চাপ, দুই ভাইয়ের পড়াশোনার টাকা জোগানো, ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে স্পেনে যাওয়ার টাকা সংগ্রহ করতে না পারাকে উল্লেখ করে। যদিও ফারদিনের বাবা এ দাবি মানতে নারাজ।
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা ডিবি ও র্যাবের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ফারদিন ইস্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনেক সন্দেহ তৈরি হয়েছে। গত ১৪ তারিখ যখন বলা হলো ফারদিন আত্মহত্যা করেছে তখন আমরা মানববন্ধনের ডাক দিয়েছিলাম কিন্তু ডিবি আমাদের তদন্তে পাওয়া প্রতিবেদন দেখতে আহ্বান জানায়। অন্য সবার মতো আমাদের মনেও সন্দেহ ছিল। যেহেতু ডিবি থেকে আমাদের সেই সন্দেহের প্রশ্ন করার সরাসরি সুযোগ দেওয়া হয়। তাই আমরা সেখানে যাই। যাতে আমাদের সন্দেহ দূর হয়।
‘শিক্ষার্থীরা ডিবি ও র্যাবের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ময়নাতদন্তের পর ডাক্তার বলেছিল তাঁর শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। তাহলে এখন কীভাবে আত্মহত্যার কথা বলা হলো। পরবর্তীতে র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ ওই ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে আমাদের জানায়, ফারদিনের শরীরে থাকা আঘাতগুলো অনেকটা কিলঘুষির মতো। কাটা চিহ্ন ছিল না। বেশির ভাগ আঘাত রক্ত জমা ছিল। এটা ব্রিজ থেকে লাফ দেওয়া কিংবা পানির আঘাত ও স্প্যানের আঘাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ডাক্তার বলেছেন, এই আঘাতের ভিত্তিতে বলা সম্ভব না যে এটা হত্যা না, আত্মহত্যা।’
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘আমরা আরও জানতে চেয়েছিলাম, যে সিসিটিভি ফুটেজ দেখিয়ে বলা হয়েছে ফারদিন ব্রিজ থেকে লাফ দিয়েছে। এর সত্যতা কোথায়? ফারদিনের শেষ লোকেশন দেখা গেছে যাত্রাবাড়ী থেকে একটি লেগুনায় উঠেছে। সেই লেগুনা তাঁকে সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাবো এলাকায় নামিয়ে দেয়। সেই লেগুনা চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এছাড়া চালকের মোবাইলের লোকেশন ও ফারদিনের ইন্টারনেট ব্রাউজিং লোকেশন ভ্যারিফাই করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছে। এই সময়ে তিনি বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করছিল। এটা করতে করতে সে ব্রিজের মাঝামাঝি চলে আসে। পরবর্তীতে যে স্থান থেকে লাফ দেয় সেখানে তাঁর মোবাইলের লোকেশন পাওয়া যায়। তাই তদন্তকারীদের ধারণা এই একই সময়ে অন্য ব্যক্তির লাফ দেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এছাড়া তারা আরও দেখেছে ওই সময়ের পরপরই ফারদিনের মোবাইল ও ঘড়ি ওই লোকেশনে বন্ধ হয়ে যায়। তাই তাঁদের ধারণা এটা ফারদিন ছিল।’
বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা জানতে চেয়েছিলাম ফারদিন যে সকল স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে তার সঠিক প্রমাণ আছে কিনা? এর ব্যাখ্যায় ডিবি ও র্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, সে রাত ১১টার দিকে বুয়েটের এক সহপাঠীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেছে। ওই সময় ফারদিন স্বাভাবিক ছিল। তিনি স্পেন যাওয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাত ১টা ৫৭ মিনিটে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে। সেই সময়েও স্বাভাবিক মনে হয়েছে তাঁদের।
‘আমরা আরও জানতে চেয়েছিলাম এক লেগুনা চালক কত দিন আগে ফারদিনকে কোথাও নামিয়ে দিয়েছে, এটা সে কীভাবে মনে রেখেছে? এর ব্যাখ্যায় ডিবি ও র্যাবের কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন, এটার বিষয় লেগুনা চালক বলেছে যাত্রাবাড়ী থেকে সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাবো এলাকায় অল্প দূরত্বে দুজনকে নামিয়েছে। ফারদিনের মোবাইলের লোকেশন অনুযায়ী দুই স্থানের কোনো একটিতে নেমেছে বলে পুলিশের ধারণা। আর লেগুনা চালকের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ফারদিনের মোবাইলের তথ্য মিলেছে।’
বুয়েট শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘মাদক, চনপাড়া বস্তি, রায়হান গ্যাং, গাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ বেরিয়েছে। এই সকল প্রশ্নের যৌক্তিক একটি উত্তর পাওয়ার দরকার ছিল। আমরা বিভিন্ন মানববন্ধনেও এই সকল প্রশ্নের জবাব চেয়েছি। এই তথ্যগুলো যেহেতু র্যাবের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে তাই আমরা এর উত্তর র্যাবের কাছে চেয়েছিলাম। কারণ মাদক, রায়হান গ্যাং ও চনপাড়া বস্তির বিষয়টি এসেছে র্যাবের মাধ্যমে। এর প্রেক্ষিতে র্যাব আমাদের বলেছে, তারা প্রথম তদন্ত শুরু করে তখন তিনটা প্রশ্ন সামনে রেখে। এটা পরিকল্পিত হত্যা, দুর্ঘটনা কিনা ও আত্মহত্যা কিনা। তদন্তের শুরুতে তারা ফারদিনের রবি নম্বরের নেটওয়ার্ক ধরে শুরু হয়। আর ফারদিনের সর্বশেষ অবস্থান অনুযায়ী তারাবো ও চনপাড়া বস্তি এলাকায় দেখিয়েছে। যেহেতু চনপাড়া বস্তি একটি অপরাধ প্রবণ হওয়ায় র্যাব সেই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে। চানপাড়ার বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা তথ্য যাচাই-বাছাই করে মিল পায়নি। এরপরে তারা সুলতানা কামাল ব্রিজের দিকে নজর দিয়েছে। আর গাড়িতে তোলা, বা সিএনজিতে ওঠার বিষয়টি র্যাব জানত না। তারা সিএনজি ফুটেজ তাদের কাছে আসে নাই। এটা ভুল হওয়ার কারণ হলো ফারদিনের শরীরে ছিল শার্ট, কিন্তু সিএনজিতে ওঠা তরুণের গায়ে ছিল কালো গেঞ্জি। সিএনজির সঙ্গে ফারদিনের মোবাইলের লোকেশন মেলেনি।’