কুয়াশিয়া, এক অন্য জগতের গল্প । বইয়ের রিভিউ


কুয়াশিয়া, এক অন্য জগতের গল্প । বইয়ের রিভিউ


বই : কুয়াশিয়া – স্পেলমেকারের অনুসন্ধান

লেখক : আশরাফুল সুমন

রিভিউ লেখক : সাকিব আহমেদ 

ছোটোবেলায় ফ্যান্টাসি ঘরানার কোনো কিছুর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল হ্যারি পটার সিরিজ। তখন অবশ্য ফ্যান্টাসি শব্দের সাথে পরিচয় হয়নি। তবে হ্যারি পটারের সাথে বেড়ে ওঠেনি এমন কিশোরদের বোধহয় খুব একটা পাওয়া যাবে না। একটি জাদুর দুনিয়া, জাদুকরদের মাহাত্ম্য… সেই সাথে খলনায়কের সাথে প্রতি মুহূর্তে ল ড়া ই। হ্যারি পটার আমাদের বিনোদনের সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম ছিল। যেই জাদুর দুনিয়ায় আমরাও হারিয়ে যেতে পারতাম।

মাঝেমাঝে মনে হতো এমন এক দুনিয়া যদি আমাদের হতো। আমাদের দেশীয় কোনো লেখক যদি এমন এক জাদুর দুনিয়া তৈরি করতে পারত! যেই দুনিয়ায় জাদু আছে। যু দ্ধে র সমস্ত উপকরণ আছে। প্রতিটি বাঁকে বাঁকে আছে উত্তেজনা, রহস্য। আমাদেরও আছে এমন এক গল্প। আজ সেই গল্পে প্রবেশ করা যাক!

▪️কাহিনি সংক্ষেপ :

সময়টা ভালো যাচ্ছে না অ্যারন এথেন্ড্রিল। তার চোখে ধরা পড়ছে এমন সব কিছু, যা তাকে পাগল করে দিচ্ছে। শুধু তার চোখেই কেন? এই পরিবর্তনগুলো কেন অন্য কেউ দেখতে পারছে না? তবে কি সে পাগল হয়ে যাচ্ছে? মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে? তার পেছনে গভীর এক রহস্য আছে। কেউ যেন কিছু বুঝতে পারছে। অ্যারনের জীবন থেকে হারিয়ে গেল তার একমাত্র প্রিয় বন্ধুটিও। যেন তার অস্তিত্বটিও ছিল না কোনোদিন। সেই সাথে অ্যারন জানতে পারল নিজের সম্পর্কে। গভীর এক ক্ষমতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে সে। সেই ক্ষমতার নাম পৃথুর্ভিক। কী এই পৃথুর্ভিক? এর ফলাফল ভালো, না খারাপ? কোনো প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।

উত্তর মেলার আগেই বি ভী ষি কা নেমে এলো অ্যারনের জীবনে। অদ্ভুত দর্শন এক জীব আক্রমণ করেছে তাদের এলাকায়। সেই আক্রমন ঠেকাতে গিয়ে নিখোঁজ হলেন তার বাবা। এমন এক জায়গায় হারিয়ে গেলেন, যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভবের নামান্তর। এমনই এক রাতে মাকে হারিয়েছিল অ্যারন। এবার কি তবে বাবা? বাবা ছাড়া যে তার আর আপন কেউ নেই। অ্যারন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। যে করেই হোক সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। কিন্তু কীভাবে? একা একজন মানুষ আর কতটা করতে পারে?

সামারলান মেডলার এমন একজন মানুষ, যে প্রয়োজনে ভিন্ন রূপে আবির্ভাব হতে পারে। কখনো ঈগল, কখনো গরিলা, কখনো বা অন্যকিছু। তার সামনে একটা মিশন। এক রহস্য দানা বেঁধেছে। যেই রহস্য সম্পর্কে জানতেই শত্রুর রাজ্যে প্রবেশ করেছে সামারলান। যেখানে একবার ধরা পড়লেও মৃত্যু অবধারিত। তবুও ঝুঁকি মাথায় নিয়ে শুধুমাত্র বাবার কথাতেই এই মিশনে এসেছে সে। তার অদ্ভুত ক্ষমতা আর অতিমাত্রায় বুদ্ধিমত্তায় সে জানতে পারে এমন কিছু, যার পেছনে অন্য কোনো শক্তি আছে। ওর পেছনে লেগেছে শত্রুপক্ষ। কোনো মতে জীবন বাঁচিয়ে পালানোর চেষ্টা। তারপরও শেষ রক্ষা হয় না। সামারলান কি নিজেকে বাঁচিয়ে ফিরতে পারবে?

আরও পড়ুন : অনার্য দেব ; এক বিশাল মহাযজ্ঞ | বইয়ের রিভিউ

এমন পরিস্থিতিতে সামারলানের সাথে পরিচয় হয় অ্যারনের। অ্যারনকে সাহায্য করার আশায় ছুটে চলে সামারলান। সাথে মিলিত হয় আরেকজন। মিলিত হয় বললে ঠিক ভুল বলা হয়। একপ্রকার জোর করেই নিয়ে আসা হয়। মেয়েটির নাম এলিস এলফিয়্যান। নির্দোষ হয়েই দেশ দ্রোহী সাব্যস্ত হওয়ার যন্ত্রণায় যে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নিজের কাছ থেকে, সবার কাছ থেকে। নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষই এমন এক পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তবুও এলিস লড়ছে। জীবনের সবকিছু হারিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে।

অবশেষে সে-ও শামিল হলো দুই যুবকের সাথে। কেননা অ্যারনকে সাহায্য না করলে ঘোর অনর্থ হয়ে যাবে। পুরনো এক প্রফেসি জেগে উঠেছে। যা বন্ধ করতে হবে। অ্যারনের বাবাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু কীভাবে?

এর উত্তর জমা আছে কুয়াশিয়াতে। হাজার বছর আগে কী ঘটেছিল? কেনই বা জাদুকরদের হাতে শিকল পরিয়ে রাখা হয়? ইচ্ছেমতো স্পেল প্রয়োগের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে কেন? কুয়াশিয়ার গভীরে কী অপেক্ষা করছে ওদের জন্য?

এ এক অন্যরকম যাত্রা। এ যাত্রায় পথে পথে বাঁধা, নানান পরীক্ষা। সবগুলোতেই সফল হতে হবে। বিফল হয়েছ তো, জীবনের আশা সেখানেই ভুলতে হবে। দিন শেষে আলো আর অন্ধকারের লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসবে কে? অপশক্তিরা অনেক বেশি শক্তিশালী। সেখানে তিন যুবক-যুবতী কী পারবে? দেখা যাক, এ লড়াইয়ের পরিণতি কী হয়…

▪️বই পর্যালোচনা ও পাঠ প্রতিক্রিয়া :

একটি জাদুর দুনিয়া। জাদুকরদের মিলনমেলা। এখানে আছে ষড়যন্ত্র, আছে যুদ্ধের সমারোহ। “কুয়াশিয়া – স্পেলমেকারের অনুসন্ধান” এমন এক উপাখ্যান, যা আপনাকে নিয়ে যাবে এক অচেনা দুনিয়ায়। যেই দুনিয়া আপনার কল্পনাশক্তিকে হার মানাতে বাধ্য। সেই দুনিয়ার সবকিছুই যেন খুব আপন। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ঘটনা যেন চোখের সামনে ঘটছে। সবকিছু উপলব্ধি করার এক মহা আখ্যান। এক অদ্ভুত আবেশে ভেসে গিয়েছিলাম। যেই আবেশে ভাসিয়ে দেওয়ার মুন্সিয়ানা লেখকের। দারুণ বললেও কম বলা হয়।

ফ্যান্টাসি জাতীয় গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকে ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং। এমন এক জগৎ লেখককে তৈরি করতে হয়, যেখানে পাঠক থাকবে নিজের মতো করে। নিজেকে সেই জগতের অংশ মনে করবে। একই সাথে সেই গল্পে ভিন্নতা আনতে হবে। নতুন সব চরিত্র, সেই সাথে ভিন্ন প্রাণীর আনাগোনা না থাকলে সব যেন অপূর্ণ থেকে যায়। সেই অপূর্ণতা লেখক আড়াল করেছেন যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সাথে। এক্ষেত্রে লেখকের প্রশংসা করতেই হয়।

“কুয়াশিয়া – স্পেলমেকারের অনুসন্ধান” মহাকাব্য লেখার জন্য লেখক যে পরিশ্রম করেছেন, তার ছাপ ছিল পুরো বই জুড়ে। এত যত্ন নিয়ে লেখক তার দুনিয়া তৈরি করেছেন সাধুবাদ দিতে হয়। পুরো বই জুড়ে সাসপেন্স, থ্রিল, টুইস্ট যেন খাপে খাপ ছিল। পাঠককে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে যেন কোনো কমতি ছিল না।

আরও : বৃষ্টিতে ভেসে যাক দুঃখ, বাতাসে ভেসে বেড়াক সুখের সুবাস | বইয়ের রিভিউ

শুধু যে যুদ্ধের গল্প, “কুয়াশিয়া – স্পেলমেকারের অনুসন্ধান” তেমনটা নয়। উপন্যাসটি গভীর এক জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এক জীবনে মানুষের যতগুলো উপাদান থাকা প্রয়োজন, বইটি যেন তারই পূর্ণ প্রতিফলন। বাবার সাথে সন্তানের যে বন্ধন থাকে তাই দেখানো হয়েছে। একজন মানুষ একা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে না। যার হয়তো অতীতে কোনো বন্ধু ছিল না, নতুন বন্ধুদের সানিধ্য পেয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে। প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব মমতার মতো বিষয় যেমন বইটিতে ছিল; ঠিক তেমনি করে রাগ, অভিমান, ক্ষোভ, হিংসা, দুঃখ বিশ্বাসঘাতকতার মতো মানবিক দিকগুলোও উঠে এসেছে।

কথার মারপ্যাঁচে একজনকে দারুণভাবে আটকে ফেলা যায়। আবার সেন্স অফ হিউমারে সবাইকে বিস্মিত করা যায়। “কুয়াশিয়া – স্পেলমেকারের অনুসন্ধান” এখানেই সবচেয়ে ব্যতিক্রম। একটি কঠিন মুহূর্ত, ল ড়া ই চলছে; এমন অবস্থায় পাঠকের উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা ঠিকই সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকবে স্বাভাবিকই। এমন অবস্থায় এমন কিছু হাস্যরস লেখক তৈরি করেছেন, সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠত। বিষয়গুলো দারুণ লেগেছে। কোনো মেকি ভাব ছিল না। যেন প্রতিটি দৃশ্যই বাস্তবসম্মত।

লেখকের লেখনী দারুণ। যদিও গল্পের শুরুতে কিছুটা আড়ষ্ট ভাব লক্ষ্য করেছি। মনে হচ্ছিল মৌলিক নয়, অনুবাদ পড়ছিলাম। অবশ্য আশি পৃষ্ঠার পর থেকে একেবারে সমাপ্তি পর্যন্ত একেবারে সাবলীল ছিল। মূল গল্পও এই আশি পৃষ্ঠার পর থেকেই শুরু হয়। এর আগের বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনায় মূল কাহিনি অনুধাবন করতে সমস্যা হচ্ছিল।

“কুয়াশিয়া – স্পেলমেকারের অনুসন্ধান” উপন্যাসটির সবচেয়ে যে বিষয় ভালো লেগেছে, তা হলো বর্ণনা। প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি অধ্যায় বর্ণনার উপর নির্ভর করে এগিয়ে গিয়েছে। একটি ফ্যান্টাসি জাতীয় লেখায় লেখক যে দ্বিতীয় স্তরের বিশ্ব কল্পনা করেন, তা পাঠকের সামনে তুলে ধরা অনেক বড়ো চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ লেখক উৎড়ে গিয়েছেন। দারুণ বর্ণনায় লেখক সবকিছু চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। পাঠক চাইলেই কোনো কিছু থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারবে না।

▪️চরিত্রায়ন :

এ জাতীয় উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রধান চরিত্র থাকে দুই কি তিনজন। একজন প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি দুয়েকজন থাকে তার সাপোর্টিভ রোলে। “কুয়াশিয়া – স্পেলমেকারের অনুসন্ধান” বইটির প্রধান চরিত্র অ্যারন। তার পাশে ছিল সামারলান, এলিস।

অ্যারন চরিত্র রুক্ষ, কিন্তু মমতাময়ী। দীর্ঘ সময় বন্ধুহীন একাকীত্ব জীবন পার করলে একটু রুক্ষ স্বভাব তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এছাড়া এলিস নিজের জীবনে অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে এসেছে। তাই যেখানেই বেঁচে থাকার একটুখানি সুযোগ হয়, সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে।

বইটিতে আমার সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র সামারলান। বেশ হিউমার সম্পন্ন, হাস্যরসে পরিপূর্ণ চরিত্রটি ছিল গল্পের প্রাণ। যে না থাকলে হয়তো অর্ধেক বইও উপভোগ করা যেত না। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মজাদার কথা বা অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে হাসি এসে যেত। দারুণ এই চরিত্রকে বেশ আপন মনে হয়েছে।

এমন গল্পে খলনায়ক থাকবে। যে থাকবে আড়ালে। আর আড়ালে থেকে তার অনুচরেরা কলকাঠি নাড়বে। সর্ষের মধ্যে ভূত হয়ে বাঁধা সৃষ্টি করবে। তাদের বিরুদ্ধেই লড়াই চলে। যে লড়াই জেতা কঠিন হয়ে যায়।

“কুয়াশিয়া – স্পেলমেকারের অনুসন্ধান” উপন্যাসে বেশ কিছু ব্যতিক্রমী চরিত্র ছিল। বৃবি, ডলোসাস, সিফসি, কুয়াশিন… আরো অনেক ভিন্ন চরিত্রের সাথে লেখক পরিচয় করে দিয়েছেন। তাদের মানুষ ভাবলে ভুল হবে। কেউ ভয়ংকর, কেউবা সুবিধাবাদী। কেউ আবার পরিস্থিতির শিকার হয়ে ভয়ংকর গিয়ে উঠেছে। এছাড়া জাদুকর সকল চরিত্র নিজগুণে আলোকিত ছিল।

▪️বানান ও সম্পাদনা :

একজন সম্পাদক যখন বই লিখেন, তখন সে বই যে নির্ভূল আকারে পাঠকের হাতে পৌঁছে যাবে তা বলাই বাহুল্য। লেখক আশরাফুল সুমন একজন সম্পাদকও। তাই “কুয়াশিয়া – স্পেলমেকারের অনুসন্ধান” বইটিতে খুব একটা সম্পাদনাজনিত ভুল লক্ষ্য করিনি। দুয়েকটা ছাপার ভুল অবশ্য ছিল। বিশাল কলেবরের বইয়ে সেটা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

▪️পরিশেষে, লেখকের ভূমিকা থেকে জানতে পারি সিরিজের সর্বমোট পাঁচটি বই আসবে। যার প্রথমটির পর এখনো দ্বিতীয়টির দেখা নেই। লেখক প্রথম বইয়েই যেভাবে বাজিমাত করেছেন, যেই আগ্রহ জাগিয়ে রেখেছেন; পরের বইয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি। হয়তো নতুন কিছুর দেখা মিলবে। দারুণ অভিজ্ঞতা হবে।