(তৃতীয় পর্বের পর)
সেদিনের পর কেটে গেছে দুটি দিন। ওরা পাঁচজন এরপর একসাথে বসার সময় পায়নি। ফোন আর অনলাইন চ্যাটের মাধ্যমে পরবর্তী কর্ম ঠিক করেছে তারা। এই দুইদিন খুব ব্যস্ত ছিল সবাই। দূরে যেতে হবে, দীর্ঘদিনের ভ্রমন। জোগাড়যন্ত্রের একটা বিষয় থাকে, তাই একসাথে মিলিত হওয়ার কোনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাদের। এছাড়া সানজিদাকে নিয়েও পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করা হয়েছে, এবার বাস্তবায়ন করতে হবে। এ নিয়ে খুব চিন্তিত সবাই। ভালয় ভালয় সব হবে তো? কোনো ভুলত্রুটি করা যাবে না।
আজ রাতে রওনা দিবে ওরা। সবাই মিলিত হবে অমির বাসায়, কেবল দীপ্তি ছাড়া। সানজিদাকে তার বাসা থেকে তুলে নিবে। সব গোছগাছ করে রেডি হয়ে বসে আছে ঐশী। আমেনা খালা তাদের জন্য রাতের খাবার প্যাক করে দিচ্ছে। দূরের পথ, ক্ষুধা লাগবে। এই রাতে ছেলে মেয়েগুলো কি খাবে? আমেনা খালার মত একজন অভিভাবক থাকলে এসব নিয়ে চিন্তা করার কারণ নেই। অমি চেয়েছিল আমেনা খালাকে সাথে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু বাসা খালি রেখে যেতে নারাজ আমেনা খালা। তাছাড়া অমির বাবা যেকোনো সময় ফিরে আসতে পারে। বাসায় একজনের থাকা দরকার।
এমন সময় কলিংবেল বাজল। অমি যেয়ে খুলল দরজা। দরজার সামনে রিফাত ও নিলয়। দুইজনের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। নতুন রোমাঞ্চের জন্য প্রস্তুত। কিছুক্ষণ পর সাদ এসে যোগ দিল তাদের সাথে।
সাদ এসেই সবার খোঁজ খবর নিলো। অমির মাথা থেকে আজকের পরিকল্পনা বের হলেও এর মূলে রয়েছে সাদ। সাদের নেতৃত্বেই আজ দীপ্তির উদ্ধার অভিযান পরিচালনা হবে।
উদ্ধার অভিযান? ব্যাপারটা আসলে তা নয়। সানজিদার বাসা থেকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় নি। আর বন্ধুকে ছাড়া ঘুরতেও যাওয়া যায় না। সে কারণে বাসার কাউকে কিছু না বলেই ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করেছে সানজিদা, অবশ্যই অমির পরিকল্পনা। সাদ, নিলয় প্রথমে এমন করা ঠিক হবে না বললেও পরে রাজি হয়ে গেছে। একটা রোমাঞ্চের ব্যাপার আছে, তা তো আর হাত ছাড়া করা যায় না।
অমির বাসাকে হেডকোয়ার্টার মেনে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে বলে ঠিক করেছে। তাই সবাই মিলিত হয়েছে এখানে। এখান থেকে সানজিদার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে, সেখান থেকে সানজিদাকে নিয়ে সবাই মিলে হারিয়ে যাবে কিছুদিনের জন্য।
সেক্ষেত্রে সমস্যা একটা আছে। সানজিদা পারবে তো পুরো পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে? অমির মত দুঃসাহসী নয় সানজিদা। মনের মধ্যে কেমন যেন ভয় কাজ করে প্রতিনিয়ত। কিসের এত ভয়, জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর মেলেনি। ভয়কে জয় করার মানসিকতা নেই বলেই তাকে নিয়ে চিন্তিত সবাই। কোনো ভজকট করে না ফেললেই হয়।
অমি জানিয়েছে, সানজিদার সাথে কথা হয়েছে তার। সবকিছুই প্ল্যান মাফিক আছে। আপাতত কোনো সমস্যা নেই। সবাই মিলে আমেনা খালাকে সাহায্য করছে তাদের ডিনার প্যাক করার কাজে। সবাই আছি, কিন্তু সানজিদা ছাড়া। বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছে সানজিদা যাবে না? ঐশী কোনো জবাব দিচ্ছে না। সাদ কেবল জানালো, ওরা সানজিদাকে বাসা থেকে নিয়ে যাবে। আমেনা খালাকে এসব অভিযানের কথা বলা যাবে না, তাহলে হয়ত বেঁকে বসবে। অমিকে যেতেই দিবে না, সেই সাথে সবার যাওয়া আটকে দিবে।
খাবার প্যাক করা শেষ হলে খালা বলল, প্যাকগুলো গাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। অমি যেন তৈরি হয়ে নেয়। অমিদের বড় গাড়িটাই ওদের ভ্রমণের জন্য ঠিক করা হয়েছে। এবং গাড়িটি চালাবে ওদের বিশ্বস্ত ড্রাইভার আনোয়ার ভাই। এসব জানিয়েছে অমি। আনোয়ার ভাই ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করার আপাতত উপায় নেই। উনি তাদের এই ভার্সিটি জীবনের অনেক কিছুর সাক্ষী।
রেডি হয়ে এসেছে অমি। আজ তাকে পরীর মত লাগছে। এমনিতেই দেখতে অসম্ভব সুন্দরী। তার উপর লাল সালোয়ার কামিজে যেন মনে হচ্ছে কোনো নায়িকা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ফেরানো দায়।
‘কিরে, তোকে তো আজ নায়িকা নায়িকা লাগছে।‘ বলেই ফেলল রিফাত। লজ্জায় লাল হয়ে উঠল অমি।
‘হয়েছে, আর কিছু বলতে হবে না।‘ কথা কাটাতে চাইলো অমি। ‘এখনই বেরিয়ে পড়া দরকার। না হলে দেরি হয়ে যাবে।‘
ঠিকই বলেছে অমি। বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। যে যার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমেনা খালাও বের হলো তাদের সাথে। একগাদা উপদেশ সবার জন্য, যেন কোনো বই রিডিং পড়ছে। অনিয়ম করা যাবে না, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া যাতে করে, রাত যেন না জাগে। আরো কত কি! সবাই কেবল মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। পালন করা না করা পরের ব্যাপার।
গাড়িতে উঠল সবাই। ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠল সাদ। একেবারে পিছনের সারিতে উঠল নিলয় ও রিফাত। তার সামনে অমি এবং সানজিদার জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। আমেনা খালাকে আলিঙ্গন করে গাড়িতে উঠল অমি। আনোয়ার ভাই গাড়ি স্টার্ট দিল। বাসা পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠল গাড়ি।
‘ম্যাডাম,’ অমিকে জিজ্ঞেস করল আনোয়ার ভাই। ‘কোথায় যাবো এখন?’
‘সানজিদাদের বাসার দিকে চলুন।‘ জবাব দিল অমি। কোনো কথা না বলে সানজিদার বাড়ির পথে গাড়ি নিয়ে চলেছে ড্রাইভার। অনেকবার সানজিদাদের বাসায় গিয়েছে তাই চিনতে অসুবিধা হবে না। এছাড়া আজকে কি করতে হবে, কি ঘটবে সবকিছু আগেই জানিয়ে রেখেছে অমি। তাই কোনো কিছু না বলেই গাড়ি চালিয়ে জায়গা মতো নিয়ে এসেছে আনোয়ার ভাই। সানজিদার বাড়ির পিছনের রাস্তায় এসে থামলো। এখান থেকে সানজিদার ঘরের জানালা দেখা যায়। ঘরের আলো দেখা যাচ্ছে। মানে, সানজিদা এখনো জেগে আছে। হয়ত ওদের জন্যই অপেক্ষা করছে।
‘ভাইয়া, সিগনাল দেন।‘ ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল সাদ। আগেই বলে রাখা ছিল, গাড়ির হেডলাইট তিনবার জ্বেলে–নিভে সিগনাল দেওয়া হবে।
সাদের নির্দেশ পেয়ে কোনো কথা না বলে একে একে তিনবার হেডলাইটের আলো জ্বলল নিভল আনোয়ার ভাই। সবাই অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে সানজিদার ঘরের জানালার দিকে। একটা কালো অবয়ব জানলার সামনে এসে মিলিয়ে গেল।
‘আরেকবার দেন।‘ নির্দেশ দিলো সাদ। আনোয়ার ভাই আবারো তিনবার আলো জ্বেলে নিভে সিগনাল দিলো। এবার শুধু অপেক্ষা।
সানজিদা আসছে না কেন? এত দেরি করছে কেন? ঘড়ির কাঁটায় অতিবাহিত হয়েছে মাত্র পাঁচ মিনিট।মনে হচ্ছে কত সময় পার হয়ে গেছে। অস্থির হয়ে উঠছে তারা। এমন সময় দৌড়ে আসতে দেখা গেল কাউকে। সানজিদাই হবে।
গাড়ি স্টার্ট দিল আনোয়ার ভাই। সাদের নির্দেশে ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, যাতে কোনো শব্দ না হয়। এত রাতে এমন নির্জন জায়গায় গাড়ির শব্দ পেলে। আশেপাশের মানুষের সন্দেহ জাগতে পারে। দরজা আগেই খুলে রাখা ছিল। লাফ দিয়ে উঠে বসল গাড়িতে।
‘এত দেরী হলো যে?’ প্রশ্ন করল অমি। ‘কোনো সমস্যা হয়েছিল?’
‘না,’ জবাব দিল সানজিদা। ‘চল, এখানে থাকা মোটেই উচিৎ হবে না।‘
‘গাড়ি ছাড়ুন।‘ আনোয়ার ভাইকে বলল পাশের সিটে বসে থাকা সাদ।
যাক, ঝামেলাবিহীন ভাবেই কাজ সম্পন্ন হলো। সিটে শরীর এলিয়ে দিল সানজিদা। ‘কখনো এমন কিছু করব ভাবতেও পারিনি।‘ বলল সে।
‘সবকিছুর অভিজ্ঞতা দরকার আছে।‘ রিফাত জবাব দিল।
‘আমি এখনো এই বিষয়টা মেনে নিতে পারছি না।‘ সাদ বলল। ‘শুধু তোদের জন্য এমন একটা কাজে সায় দিয়েছি।‘ একটু থেমে বলল, ‘তোদের পাল্লায় পড়ে আর কি কি যে করতে হবে, আল্লাহ মালুম।‘
‘অনেক কিছু করতে হবে,’ অমি বলল। ‘আমরা তো গ্রামে যাচ্ছি। ঐখানে তোকে গাছে উঠে আম পাড়তে হতে পারে। হতে পারে তোকে আমরা পুকুরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম, সেখান থেকে উঠে আসতে হতে পারে।‘
অমির কথাগুলো শুনে সাদের চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেছে। বাকিরা হো হো করে হেসে উঠল। কথাগুলো হয়ত মজা করে বলা, কিন্তু এমন পরিস্থিতি আসলে অমি যে এই কাজগুলো করতে পারে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সাবধানে থাকতে হবে।
‘অনেক ক্ষুধা লেগেছে,’ বলল নিলয়। ‘এখন কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।‘
‘এতক্ষণ পর একটা কাজের কথা বলেছিল।‘ রিফাত বলল। তার মুখের হাসি একান থেকে ওকান পর্যন্ত ঠেকেছে। খাবারের কথা তাকে যতটা আনন্দ দেয়, আর কিছুতেই হয়ত সে আনন্দ পায় না।
আনোয়ার ভাইকে গাড়ি একপাশে পার্ক করতে বলল অমি। যার যার খাবারের প্যাক হাতে তুলে দিল। সবাই তৃপ্তি ভরে খাচ্ছে। হাসি, ঠাট্টা, গল্পে কাটছে সময়। এতক্ষণ সবার মাথায় চিন্তা ছিল। সব চিন্তা দূর হয়ে গিয়েছে। এটাই স্বস্তির।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো আনোয়ার ভাই। গাড়ি ছুটতে পূর্ন গতিতে। চারিদিকে রাতের নিস্তব্ধতা, কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে সব। কেবল গাড়ির হেডলাইট দুটোই জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মাঝে মাঝে দুই একটা ট্রাক–বাস পার হওয়ার সময় চোখে পড়ছে আলো। এছাড়া সবই ঘন কালো আধারে ঢাকা। আর ওই দূর আকাশের চাঁদটাও আজ যেন লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। মেঘলা আকাশে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থেকে মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে আলো দিচ্ছে এই ধরণীকে।
সারাদিন কম বেশি ধকল গিয়েছে সবার। শারীরিক, মানসিক চাপে ক্লান্ত সবাই। ছেলে মেয়েগুলোর হই চই থেমে গেছে। ঢুলতে ঢুলতে এক এক করে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম নেই সাদের চোখে। এই আধারের প্রকৃতি দেখা হয় নি অনেকদিন। চাঁদের সাথে ছুটে চলা, অন্ধকার চিরে এই ধরণীকে আলোকিত করা এক কথায় অসাধারণ। চাঁদ–মেঘের এ লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে কখন যে সেও ঘুমিয়ে পড়েছে তার খবর নেই। একমাত্র ঘুমহীন চোখে আনোয়ার ভাই গাড়ি ছুটিয়ে চলেছে।
চলবে…
পেপারস লাইফ/গল্প/সাকিব আহমেদ