(পঞ্চম পর্বের পর)
‘সানজিদা কি এখনো ঘুমাচ্ছে,’ প্রশ্নটা করলেন সানজিদার বাবা আমিনুল হক। ডাইনিং টেবিলে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। সামনে সকালের নাস্তা। আমিনুল হকের নীতিতে সকালের নাস্তা একসাথে করবে পরিবারের সবাই। এতদিন সে নিয়ম চলে এসেছে। আজকে সানজিদার দেখা নেই।
ঘড়ির দিকে তাকালেন সানজিদার মা। দশটা বেজে গিয়েছে। এত দেরি তো করে না মেয়েটা? হয়ত কাল রাতে দেরি করে ঘুমিয়েছে। ভাবলেন সানজিদার মা। বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু বাবার অমতে সে সুযোগ পাবে না মেয়েটা। মন খারাপ করেই হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে।
‘আমি যেয়ে ডেকে আনছি।’ সানজিদার মা বললেন।
‘ওকে বলে দিও, আমি ইনডিসিপ্লিন একদম পছন্দ করি না।’ ভারী কণ্ঠে বললেন আমিনুল হক। মাথা নেড়ে সানজিদাকে ডাকতে চললেন মা। আমিনুল হকের পাশের চেয়ারটাতে বসে আছে তাদের বড় ছেলে, সানজিদার ভাই হৃদয়। নীরবে নাস্তা করে যাচ্ছে। কোনো জবাব দিল না। এই বাসায় একজনের হুকুমেই সব চলে। তার কথাই শেষ কথা। সে তাদের বাবা। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস বা দুঃসাহস, কোনটিই তাদের নেই। মাঝে মাঝে ক্ষোভ জমে বাবার উপর। তারা তো কোনো অন্যায় করে না, বিপথে যায় না। তারপরও তাদের উপর এত এত করা নিয়ম কানুন চাপিয়ে দেওয়ার দরকার কি? মাঝে মাঝে মনে হয় এসব নিয়ম কানুন ভেঙে কিছু একটা করে ফেলতে। সে সাহস আর হয়ে উঠে না। আজ হৃদয়ের মনে হচ্ছে ছোট বোনটা এমন কিছু ঘটাতে যাচ্ছে যার জন্য সবকিছু ওলট পালট হয়ে যেতে পারে। কেন মনে হচ্ছে সে নিজেও জানে না।
হৃদয় সানজিদার থেকে বছর চারেক বড়। সদ্য অনার্স শেষ করেছে সে। এখন চাকরি পাওয়ার অপেক্ষা। বাবা বলে দিয়েছেন, নিজের চাকরি নিজে খুঁজে নিতে। বাবার এত পরিচিত থাকতেও ছেলের জন্য কিছু করবেন না। হৃদয়ের এখনই চাকরি করতে ইচ্ছা করে না, সে এখনো জীবনটাকে উপভোগ করতে চায়। বোনের জন্য তার মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। ছেলে হওয়ায় জীবনকে কিছুটা হলেও উপভোগ করার, কিন্তু বোন সে সুযোগ পায় নি।
‘সানজিদা, এখনো ঘুমাচ্ছো?’ দীপ্তির ঘরের সামনে এসে ডাক দিলেন মা। কোনো সাড়া নেই। ‘সকাল হয়েছে, উঠো। তোমার বাবা ডাকছেন। দশটা বাজে কিন্তু।’ আবার বললেন তিনি। এবারও কোনো শব্দ নেই ভিতরে।
‘সানজিদা?’ এবার একটু উঁচু গলায় ডাক দিল তার মা। দরজায় ধাক্কা দিলেন। হাতের ছোঁয়ায় পাল্লাটা আপনাআপনি আলগা হয়ে একটু ফাঁক হয়ে গেল। ধাক্কা দিতেই পুরোপুরি দরজাটা খুলে গেল। সানজিদা ঘরে নেই। বিছানাটা পরিপাটি করে সাজানো। দেখলে মনে হয় রাতে কেউ বিছানায় শোয় নি। এক অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠল দীপ্তির মায়ের। কোথায় গেল মেয়েটা?
খুব দ্রুত বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে নাম ধরে ডাকলেন, ‘সানজিদা, সানজিদা?’ না, সানজিদা নেই। বেশ বুঝতে পারছেন সানজিদা এ বাসাতেই নেই। কোথায় গেল? কোনো বিপদ হলো না তো? ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, এমন সময় সাদা একটা কাগজ চোখে পড়ল। ভাঁজ করে টেবিলের উপর রাখা। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটি হাতে নিলেন। ভাঁজ খুলে দেখলেন একটি চিঠি, সানজিদার লেখা।
একনজর চোখ বুলিয়ে পুরো লেখাটা পড়লেন। হাতের কাঁপুনি আরো বেড়ে গেল তার। মেয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। কি করবে এখন? সানজিদার বাবা শুনলে তো রেগে যাবে। কিছু তার করার নেই। বলতেই হবে। মেয়েটা যে এমন করবে তা কে ভাবতে পেরেছিল? দৌড় দিয়ে সানজিদার ঘর থেকে বের হলেন সে।
‘শুনছ? সানজিদা ঘরে নেই।’ চিৎকার করে বলতে লাগলেন তিনি।
‘ঘরে নেই মানে?’ জিজ্ঞেস করলেন আমিনুল হক। উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে। কিছু না বলে হাতের চিঠিটা সামনে বাড়িয়ে ধরলেন সানজিদার মা। হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলেন আমিনুল হক –
“বাবা, আমি সবসময় তোমার কথা শুনে এসেছি। কখনো তোমার অবাধ্য হই নি। কিন্তু আজ হচ্ছি। তোমার মেয়ে এখন বড় হয়েছে। তার ইচ্ছা বা চাওয়া-পাওয়া বলে কিছু থাকতে পারে। তুমি কখনো তা বুঝতে চাও নি। সবসময় নিজের সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছ। ভাইয়া বা আমি কখনো তোমার মুখের উপর কথা বলিনি। তোমাকে অসম্মান করি নি। আমি তোমার মেয়ে। তোমার আদর্শের অসম্মান হোক, আমি তা কখনো চাইবো না। আজ আমি তোমার অবাধ্য হয়ে বের হলাম। বন্ধুদের সাথে এই দুনিয়াটা চিনতে চাই। নিজেকে চিনতে চাই। চারদেয়ালে আবদ্ধ হয়ে আমি বড্ডবেশি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। নিজেকে খাঁচায় বন্দি কোনো এক পাখি মনে হয়, যে মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়তে চায়। কিন্তু পারে না। আজ আমি সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিজেকে মুক্ত করার, ডানা মেলে উড়ে বেড়াবার। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি ছুটি শেষে চলে আসব। মাকে চিন্তা করতে নিষেধ করো। সময় হলে আমি নিজেই যোগাযোগ করব। ভালো থেকো তোমরা। আমি ভালো আছি।
ইতি তোমাদের মেয়ে সানজিদা”
চিঠিটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। হৃদয় কিছু বুঝতে পারছে না। কি আছে ওই কাগজে লিখা? সবার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভালো কিছু অবশ্যই নয়। কাগজটা নিয়ে পড়তে শুরু করল। এক নিঃশ্বাসে পুরো চিঠিটা পড়ল সে। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। যেন কোঠর ঠেলে বেরিয়ে আসবে এক্ষুণি। যেই মেয়ে বাবার মুখের উপর কথা বলতে ভয় পেত, সে এত বড় দুঃসাহসের কাজ করতে পারল! ভাবাই যায় না। মনে মনে খুশি হলো হৃদয়। আর কতদিন এমন বন্দী দশা পার করবে দুই ভাইবোন। তাদেরও একটা জীবন আছে। এই নরকে দম বন্ধ হয়ে আসে প্রতিনিয়ত।
‘আমি জানতাম এমন কিছু একটা হবে।’ চিৎকার করে বলল হৃদয়। ‘আমরাও মানুষ, কোনো আসামী না। আজ বোনকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে দিলে এমন অবস্থা হতো না।’ উঠে দাঁড়ালো হৃদয়। প্লেটের অর্ধেক খাবার ফেলেই চলে গেল।
‘খেয়ে যাও হৃদয়।’ পিছন থেকে মায়ের ডাক শোনা গেল। কে শোনে কার কথা? এই পরিস্থিতিতে আর যাই হোক খাওয়া যায় না। বোনটার জন্য চিন্তা হচ্ছে ভীষন। হৃদয়ের পৃথিবী বলতে তার ওই এক বোন। ওর অসুবিধা হবে না তো? যদি কোনো বিপদ হয়? সানজিদার বন্ধুদের চেনে সে। একবার দেখা হয়েছিল। তারা নেহাতই খারাপ নয়। বন্ধুর কোনো বিপদ হতে দিবে না।
হৃদয় চলে যাওয়ার পরও সানজিদার বাবা একইভাবে বসে আছেন। মুখে কোনো কথা নেই। বলার হয়ত কিছুই নেই। মেয়েটা যে এমন করবে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। সানজিদার মা পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
‘আমি কি খুব নিয়ম কানুনে ছেলে মেয়েদের বেঁধে রেখেছিলাম?’ আমিনুল হকের জিজ্ঞাসা। জবাব দিতে পারলেন না সানজিদার মা। আবার বললেন দীপ্তির বাবা, ‘ আমি তো তাদের ভালো চাইতাম। এই জন্য তাদের এমন কড়া শাসনে রেখেছিলাম। ওদের জন্য যে এটা বোঝা ছিল, বুঝিই নি।’
‘ছেলে মেয়েরা তো বড় হয়েছে,’ এবার মুখ খুললেন সানজিদার মা। ‘ওরাও ওদের মত থাকতে চায়। ঘুরে ফিরে বেড়াতে চায়। ওদেরকেও তো বুঝতে পারিনি আমরা।’ তারপর থেমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কি করবে?’
‘পুলিশের কাছে যাবো।’
‘পুলিশ?’ আঁতকে উঠলেন সানজিদার মা। ‘মেয়ে তো লিখেছে ফিরে আসবে। পুলিশকে জানানোর কোনো দরকার আছে?’
‘ফিরে আসবে, এই ভেবে তো বসে থাকতে পারি না।’ হঠাৎই চিৎকার করে উঠলেন সানজিদার বাবা। ‘যদি কোনো বিপদ হয়? যাদের সাথে গিয়েছে তারাও তো ছেলে মানুষ।’
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিজের ঘরে যেয়ে বাসার পোশাক ছেড়ে প্রস্তুত হয়ে নিলেন। থানায় যেতে হবে। একবার বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন সানজিদার মা। লাভ হলো না। যে কথা তার মুখ দিয়ে একবার বের হবে, সে সেটা করেই ছাড়বে। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।
চলবে…
পেপারস লাইফ/ গল্প/সাকিব আহমেদ
পড়ুন :