(ষষ্ঠ পর্বের পর)
গোসল সেরে বের হলো রিফাত। মরার মতো ঘুমিয়ে আছে দুই বন্ধু। প্রথমে ডাকবে ভাবল, পরে ভাবল না থাক। ঘুমাক ওরা। কাল সারারাত ধকল গেছে। ঘুম ফাহিমেরও আসছে। এখন ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না। ওদেরকে বিরক্ত না বাইরে এলো।
বাগানে এসে দাঁড়ালো সে। অসাধারণ পরিবেশ। মনটা যেন ভাল হয়ে যায়। বাগানের একপাশে বেতের সোফাসেট সাজানো। মাঝে ছোট টেবিল। আড্ডা দেওয়ার জন্য অসাধারণ জায়গা। ঢাকার যান্ত্রিক জীবন থেকে দূরের এমন এক জায়গা খুব সহজেই মন কেড়ে নেয়। মতিন চাচা ফুলে পানি দিচ্ছে।
রিফাতকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু লাগবে বাবা?’
‘না, চাচা।’ জবাব দিল রিফাত। ‘লাগলে আপনাকে বলব।’
‘তোমার বন্ধুরা কোথায়?’
‘সাদ, নিলয় ঘুমাচ্ছে। কাল সারারাত জার্নি করে ওরা খুব টায়ার্ড। অমি আর সানজিদা কি করছে জানি না।’
‘তুমিও বিশ্রাম নিয়ে নিতে।’
‘ইচ্ছে করছে না। জায়গাটা ভালো লাগছে। একটু ঘুরে দেখি আশেপাশে।’
‘ঠিক আছে, তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো সব। আমি যাই। অনেক কাজ পড়ে আছে।’ চাচা ভিতরে চলে গেল। রিফাত হেঁটে বেড়াচ্ছে। সাদ বলে, গ্রামের মাটির অদ্ভুত গন্ধ আছে। আজ সেই বিষয়টা সত্যি সত্যি উপলব্ধি করতে পারছে রিফাত। ঢাকার যান্ত্রিক পরিবেশে থেকে এদেশের এত সুন্দর রূপ বুঝতে পারেনি। গ্রামকে বরাবরই অবজ্ঞা করেছে। কিন্তু এই গ্রামের মাটি মন টানছে। সত্যি, অদ্ভুত এ মায়ার টান। এই বুঝি মায়ার বাঁধন! নতুন জায়গা, অপরিচিত পরিবেশ। তবুও কেমন যেন নিজের, কত আপন এ জায়গা।
এমনটা কেন লাগছে? আধুনিক যুগের ছেলে রিফাত। শহরের চারদেয়ালে আবদ্ধ থেকেই বেড়ে উঠেছে। গ্রামের এই মায়ার সাথে সখ্যতা নেই। তবুও যেন মনে হয়, এই মাটি নিজের। এই মাটি ভালো লাগার। আলতো করে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে গ্রাম বাংলার এই মাটিকে। যেখানে ভেজালের ছিটেফোঁটাও নেই, পুরোটা খাঁটি সোনা।
‘ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?’ অমির ডাকে বাস্তবে ফিরে আসে রিফাত। অমিকে অপূর্ব লাগছে। খোলা চুল ভিজে আছে, সদ্য গোসল করে এসেছে। ভেজা চুলগুলো মুখে এসে পড়ছে। চোখদুটো উজ্জ্বল ভাষায় যেন কিছু বলছে। এই গ্রামবাংলার প্রকৃতির সাথে যেন মিলেমিশে একাকার।
চোখ সরাতে পারছে না রিফাত। তবুও যে সরাতে হয়। বন্ধুর দিকে এভাবে দৃষ্টি দেওয়া যে পাপ! কোনো মতে চোখদুটো অন্যদিকে নিয়ে অমির দিকে এগিয়ে গেল রিফাত।
‘তোদের গ্রামটা বড্ড সুন্দর’, অমিকে বলল রিফাত। অমি জবাব দেয় না। রিফাতের মতো মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করে অপার এ প্রকৃতি। অমি অনেকটা এক্সট্রোভার্ট ধরণের। আধুনিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছে। গ্রামের জীবন তার কাছে ছিল অবজ্ঞার বিষয়। তার বাবা অনেকবার তাকে এখানে নিয়ে আসতে চাইলেও কখনো তার ইচ্ছে হয়নি এখানে আসার। অবহেলাই করেছে বারবার। তাচ্ছিল্যের সাথে উপহাস করেছে বন্ধুদের আড্ডায়। অমির মতো তার বন্ধুরাও হাসি তামাশায় মেতেছিল তখন। কেবল সাদ ব্যতিক্রম। ছোটবেলায় একটা সময় এই গ্রামীন সমাজে পার করে সাদ চারদেয়ালের শহরে গ্রামের আলো ছায়াকে মিস করে ভীষন। সাদের কথাই ঠিক। এতদিন ভুল ছিল অমি। এই পরিবেশের সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। এই প্রকৃতি সুন্দর, অদ্ভুত সুন্দর।
পুলিশের বড় কর্তার সামনে বসে আছেন সানজিদার বাবা আমিনুল হক। কিছুক্ষণ আগে এসেছেন। অভিযোগ করেছেন তার মেয়ে হারিয়ে গেছে। তবে তার অভিযোগ শোনার মতো সময় নেই পুলিশের। বড্ড বেশি ব্যস্ততা এখানে। যতটা না সত্যিকারের ব্যস্ততা, তার চেয়ে বেশি লোক দেখানো। অন্তত আমিনুল হকের কাছে তাই মনে হচ্ছে।
‘আপনার মেয়েকে তাহলে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?’ চোখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলেন পুলিশের বড় কর্তা।
‘জ্বি,’ ছোট্ট এক শব্দে জবাব দিলেন সানজিদার বাবা।
‘কি নাম আপনার মেয়ের?’
‘সানজিদা।’
‘কোথায় যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?’
‘আমার কোনো ধারণা নেই। সেই জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি।’
‘আপনার মেয়ের কোনো ছবি এনেছেন?’
‘জ্বী, এনেছি।’ বুক পকেটে থেকে ছবিটা বের করে দেখালেন আমিনুল হক।
‘টেবিলে রেখে যান। দেখি কি করতে পারি।’ বলে একটু সামনে ঝুঁকলেন পুলিশ অফিসার। এরপর ফিসফিস করে বললেন, ‘দেখুন, আপনার মেয়ে বড় হয়েছে। এখন এডাল্ট। হয়ত কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছে। এখন এমন অহরহ ঘটছে বলেই বললাম। ছবিটা রেখে যান, দেখি কি করা যায়।
‘ধন্যবাদ,’ বলে উঠে দাঁড়ালেন সানজিদার বাবা। আর কিছু বলার রুচি নেই তার। মেয়ে সম্পর্কে এমন কথা শোনার পর মনটা আরো তিক্ত হয়ে উঠেছে। ছবির সাথে আরেকটি জিনিস দিতে চেয়েছিল সে। দীপ্তির চিঠি। সেটা দেওয়ার এখন আগ্রহ নেই। পুলিশ কিছু করবে না। যা করার নিজেকেই করতে হবে। কিন্তু কি করবে সে? কোথায় খুঁজবে? তা বন্ধুদের কাউকে তো সে চিনে না। এক-দুইবার বাসায় দেখেছিল, সেভাবে কথা হয় নি। বা সে বলেনি। সবসময় নিজের মাঝে গাম্ভীর্য, আভিজাত্যের ভাব ফুটিয়ে কারো সাথে ঠিক মতো কথা বলতেন না বলেই কি আজ তার এই অসহায়ত্ব? ছেলে-মেয়েরা তার সাথে মন খুলে কথা বলত না। প্রচন্ড ভয়েই কারণে তার থেকে দূরেই থাকত! বাবাকে ছেলে-মেয়েরা ভয় পাবে। কিন্তু এতটা ভয়ের জন্য দায়টা তার নিজের বলেই মনে করছেন আমিনুল হক।
মেয়ের জন্য বুকটা হাহাকার করছে। কি করছে মেয়েটা? কোথায় আছে? ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেছে কি? কাল অতটা কঠোর না হয়ে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি দিলে আজ মেয়েটার খবর পাওয়া যেত। এসব ভাবতে ভাবতে বাসার গেটের সামনে চলে এসেছেন আমিনুল হক। কিন্তু বাড়ির ভেতর জওতে ইচ্ছে করছে না তার। বাড়ির মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আনমনা ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছেন। এই দৃষ্টি ঝাপসা, কিছুই দেখে না। যেন মেয়েকেই খুঁজছেন দূরে কোথাও।
চলবে…
পেপারস লাইফ/গল্প/সাকিব আহমেদ
পড়ুন :