যে গল্পের নায়ক “পুরান ঢাকা” | বইয়ের রিভিউ


পুরান ঢাকা


বই : গল্পে গল্পে পুরান ঢাকা

লেখক : আশিক সরওয়ার

রিভিউ লেখক : সাকিব আহমেদ

প্রকাশনী : পেপার ভয়েজার

পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১১১

মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা

 

কবি হাসে, টাকা ভাসে

গঙ্গাবুড়ির শহরে…

কাব্যের মতো থাকা শহর আজ রূপহীন, বর্ণহীন। গঙ্গাবুড়ির এ শহরে আগেও টাকা উড়ত, এখনো টাকা ওড়ে। টাকার ভারে নুয়ে পড়ে ইতিহাস, ঐতিহ্য। কিন্তু হারিয়ে যায় কি?

চারশত বছরের পুরনো এ শহরের গল্পও বেশ পুরনো। বরঞ্চ তারচেয়েও আগে থেকে ঢাকা গল্প লিখছে। এক একটি বিস্ময়কর সেসব গল্প। যে সব গল্পের রোমাঞ্চে না ডুবে থাকা যায় না। কত রাজা-প্রজা, সাহেব-নবাবদের পায়ের ধুলোয় এই ঢাকা প্রাণ ফিরে পেয়েছে, তার খবর কে রাখে? সেই সব গল্প তো রূপকথার মতো শোনায়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তা নিছক-ই কল্পনা।

এই কল্পনাকে স্মৃতির পাতায় একে ঢাকার সমৃদ্ধ ইতিহাস জানানোর এক ছোট্ট প্রয়াস লেখক আশিক সরওয়ারের। লিখেছেন “গল্পে গল্পে পুরান ঢাকা”র মতো একটি বই। যেখানে তিনি খুলে দিয়েছেন নিজের স্মৃতি। নিজেকে বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে পুরান ঢাকার সাথে তার পথচলায় শামিল করেছেন আমাদেরও। ইতিহাস কথা বলে। সেই ইতিহাস যেন গল্প বলেছে আশিক সরওয়ারের কলমে আর তার অভিজ্ঞতায়। কী ছিল সেসব গল্পে?

আরও পড়ুন : ক্রিকেটের আলোর পেছনে আছে অন্ধকার | বইয়ের রিভিউ

“ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত” – এই একটি বাক্য ছোটোবেলা থেকে মুখস্ত করেনি, এমন শিশু পাওয়া খুব দুষ্কর। সেই বুড়িগঙ্গার পাড়ে গড়ে ওঠা ঢাকা আজ বিবর্ণ, ধূসর। আর বুড়িগঙ্গা? রূপ, যৌবন হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে জানান দিচ্ছে অন্তিমলগ্নের। এই বুড়িগঙ্গার ইতিহাস কেমন ছিল? অনেক মিথ, কিংবদন্তির জন্ম এ বুড়িগঙ্গাকে নিয়ে। সেগুলোর অনেক কিছুই জানান দেয়, “গল্পে গল্পে পুরাণ ঢাকা” বইটি।

এছাড়াও বইটিতে আছে বাংলাবাজারের ইতিহাস। বইপড়ুয়াদের জন্য বাংলাবাজার একটি আদর্শ জায়গা। যেখানে লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের মিলনমেলা বসে। এই বাংলাবাজারের ইতিহাস কী? বইয়ের বিশাল এই ব্যস্ততম জগৎ তৈরির পেছনের গল্প জানতে হবে না?

কিংবা মঙ্গলাবাসের গল্প? ঢাকা শহরের অনেক প্রাচীন স্থাপনা আর নেই। হয় বেহাত হয়ে নতুন কোনো গল্পের সাক্ষী, অথবা সংরক্ষণের অভাবে প্রাণহীন হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মঙ্গলাবাস তার ঐতিহ্য হারিয়ে আজ ছাত্রাবাস। ছোটো কাটরা, বড়ো কাটরা শেষ সময়ের অপেক্ষায়। একই অপেক্ষায় পাগলা সেতুর শেষ অবয়ব বা শঙ্খনিধিদের ঐতিহ্য।

আরও পড়ুন : বৃষ্টিতে ভেসে যাক দুঃখ, বাতাসে ভেসে বেড়াক সুখের সুবাস | বইয়ের রিভিউ

লেখক বইয়ে ‘রোজ গার্ডেন প্যালেস’ নামের হুমায়ূন সাহেবের বাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন। আমার বাসার থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। কলেজ জীবনে বহুসময় আড্ডায় ব্যয় করেছি সে জায়গায়। ছবি তোলার নেশায় ঢু মেরেছি। সে স্মৃতি কি ভোলা যায়? লেখকের লেখায় সেই স্মৃতিগুলো মানসপটে জেগে উঠছিল বারবার। কিংবা ঢাকা কেন্দ্র। করোনার সময়কালে তখন ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ। তারপরও যোগযোগ করে চলে গিয়েছিলাম “কিংবদন্তির ঢাকা” বইটি হস্তগত করার জন্য। সেখানেই এক বিশাল বাংলার ইতিহাস জানতে পারি। “গল্পে গল্পে পুরান ঢাকা” বইয়ে সেই ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখক।

লেখকের লেখায় উঠে এসেছে গেন্ডারিয়া, ধোলাইখালের মতো জায়গা ও তাদের ইতিহাস। যেই ইতিহাসের গল্পে চমকে যেতে হয়। এত ঐতিহ্যবাহী ছিল আমাদের ঢাকা! যেই ঢাকার প্রেমে একবার মজলে আর কোনোকিছুর দিশা থাকত না। আর আজ? লেখকের লেখায় সেসব এলাকায় গল্প পড়ে আমিও স্মৃতির পাতাতে হারিয়ে যেতাম। বাসার কাছে থাকার সুবাদে সেসব জায়গায় কম যাওয়া যে হয়নি।

লেখক বর্ণনা করেছেন গোল তালাবের ইতিহাস। “গল্পে গল্পে পুরান ঢাকা” বইতে আরও আছে বিবি মরিয়ম কামানের খোঁজ। এর পেছনের ইতিহাস, কিংবদন্তি লিখেছেন লেখক। এছাড়াও আছে গোলাপ শাহ মাজারের পেছনের গল্প। আছে ঢাকাইয়া কুটির সেই ইতিহাস। ঢাকাইয়াদের বিশেষ ভাষার সেই ইতিহাসের গল্প জানতে হবে না?

এই বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ আমার কাছে একজন বিদেশিনীর গল্প। জিনেট ভান তাসেল নামের সেই বিদেশিনীর শখ ছিল আকাশ ছোঁয়ার। সেই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন বিভোর সেই নারীর পা পড়েছিল ঢাকার বুকে। নবাবদের খামখেয়ালীর বসে আর ঢাকাবাসীকে বিনোদন দিতে প্রস্তুত জিনেট। কিন্তু…. শেষ পরিণতি মানতে পারবেন তো?

এছাড়াও নানান ইতিহাস, গলিঘুপচি পার করে লেখক গল্প বলে গিয়েছেন। সেই গল্পে বিমোহিত হতে হয়। হারিয়ে যেতে পুরনো সে ঢাকার খোঁজে। যেই ঢাকার বুকে একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ত, আজ সেই ঢাকায় শুধুই হতাশা।

আশিক সরওয়ারের লেখা প্রথমবার পড়লাম। লেখকের লেখনী, ভাষাশৈলী, শব্দচয়নে মুগ্ধ হতে হয়। গল্প বলার ছলে লেখক শুধু নিজের অভিজ্ঞতা-ই বর্ণনা করেছেন আর দিয়ে গিয়েছেন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। “গল্পে গল্পে পুরান ঢাকা” কোনো প্রামাণ্য দলিল নয়, লেখকের যাত্রাপথে তার সাথে সঙ্গী হওয়া কেবল। লেখক ঢাকাকে নিয়ে এক কাব্য রচনা করেছেন। যে কাব্যে উঠে এসেছে ঢাকার শুরু থেকে, নানান ঐতিহ্যের উপকরণ।

“গল্পে গল্পে পুরান ঢাকা” বইয়ে বানান ভুল ছিল না বললেই চলে। শেষের দিকে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ লক্ষ্য করেছি। তেমন দুয়েকটা বাক্য গঠনে অসঙ্গতি ছিল। এছাড়া প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বাঁধাই, সম্পাদনা সব ছিল একশয়ে একশ। অভিযোগ করার কোনো জায়গা নেই।

 

এই শহর, জাদুর শহর

প্রানের শহর ঢাকারে….

জাদুর শহর আজ নিজেকে হারিয়ে খুঁজছে। প্রাণের শহর আজ প্রাণহীন। ঢাকা যে বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। যেই ঢাকার গল্পে বিস্ময়, বিমুগ্ধতা! সেই ঢাকা আজ হারিয়েছে তার রঙ। চারশ’ বছরের পুরনো যেন মাথা নুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। একসময় হয়তো দাঁড়িয়ে থাকার ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলবে প্রাচীন এ নগরী। তখন কেবল গল্পে বা কোনো উপন্যাসে ঢাকাকে পাওয়া যাবে। আর তখনকার প্রজন্ম মনে করবে বাস্তবে নয়; কল্পনায় কিংবা রূপকথার গল্পে এমন এক শহর ছিল। যাকে ঢাকা বলা হতো…