বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শ্রীলংকায় মুসলিম কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ দাহ করতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। শ্রীলংকা হচ্ছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ১৮২টি সদস্যের মধ্যে একমাত্র দেশ – যেখানে কোভিড-১৯এ মৃত মুসলিমদের দাহ করা হচ্ছে।
করোনায় মৃত মুসলিমদের পরিবারগুলো বলছে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া লোকদের কবর দেয়া যাবে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তাদের মৃতদেহ দাহ করতে বাধ্য করছে।
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে, স্থানীয় কিছু গোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামপন্থীরা শ্রীলংকার পূর্বাঞ্চল ও রাজধানী কলম্বোর কিছু নামীদামী হোটেল ও গির্জা লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায় – যাতে বিদেশী সহ ২৫০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়। শ্রীলংকার অনেক মুসলিমই মনে করেন – ওই আত্মঘাতী হামলার পর থেকে তাদেরকে ‘দানব’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শ্রীলংকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মুসলিম ব্যক্তি মারা যান ৩১শে মার্চ। এর পর থেকে কিছু সংবাদমাধ্যমে খোলাখুলিভাবেই মুসলিমদের ওই মহামারি ছড়ানোর জন্য দায়ী করা হতে থাকে – যদিও ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে সরকারিভাবে মাত্র ১১ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। এই ১১ জনের সবার মৃতদেহই দাহ করা হয়েছে।
মে মাসের ৪ তারিখ তিন সন্তানের মা ৪৪ বছর বয়স্ক ফাতিমা রিনোজাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি কোভিড -১৯ সংক্রমিত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। যেদিন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সেদিন থেকেই কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারের ওপর ‘চড়াও হয়’ বলে অভিযোগ করেন ফাতিমার স্বামী মোহামেদ শফিক।
এ বিষয়ে শফিক বলেন, “পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী কর্মকর্তাদের নিয়ে আমাদের বাড়ির দরজায় এসে হাজির হয়। আমাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়, সবখানে জীবাণুনাশক ছিটানো হয়, আমরা সবাই ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু তারা আমাদের কিছু বলেনি। এমনকি তিন মাসের বাচ্চাকেও ভাইরাস টেস্ট করা হয় -তারপর তারা আমাদেরকে কুকুরের মত করে কোয়ারেন্টিন সেন্টারে নিযে যায়। পুরো পরিবারটিকে এক রাত সেখানে আটকে রাখা হয়, কিন্তু পরদিন তাদের ছেড়ে দিয়ে বলা হয়, তাদের দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
এর মধ্যেই খবর আসে যে ফাতিমা মারা গেছেন। তিনি একাই হাসপাতালে ছিলেন। ফাতিমার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে বলা হলো হাসপাতালে গিয়ে তার মায়ের মৃতদেহ সনাক্ত করতে।
তাকে বলা হলো, যেহেতু কোভিড-১৯এ ফাতিমার মৃত্যু হয়েছে তাই তার মৃতদেহ পরিবারের কাছে ফেরত দেয়া হবে না।
ফাতিমার ছেলে জানান, তার মায়ের মৃতদেহ দাহ করার অনুমতিসূচক কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে তাকে বাধ্য করা হয় – যদিও মুসলিম আইনে মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলাকে মানবদেহের অবমাননা বলে মনে করা হয়।
শফিক বলেন, “আমার ছেলেকে বলা হয়, আরো কিছু পরীক্ষা করার জন্য ফাতিমার দেহের কিছু অংশ কেটে নিতে হবে। তার যদি করোনাই হয়ে থাকে তাহলে তার শরীরের অংশ কেটে নেয়ার দরকার কী?”
শফিক মনে করেন, আসলে কী ঘটেছিল তা তার পরিবারকে পুরোপুরি জানানো হয়নি।
ফাতিমার পরিবারসহ শ্রীলংকার আরো কিছু মুসলিম পরিবার মিলে তাদের বিরুদ্ধে “মহামারিকে ব্যবহার করে বৈষম্যমূলক আচরণ করার জন্য” সরকারের সমালোচনা করেছে।
এদিকে সরকারের প্রধান সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ড. সুগত সামারাবীরা বলেছেন, সরকারের নীতি হচ্ছে কোভিড-১৯এ আক্রান্ত বা আক্রান্ত সন্দেহে যারাই মারা যাবে – তাদের মৃতদেহ দাহ করা হবে। কারণ কবর দেয়া হলে তা ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তরকে দূষিত করতে পারে।
ড. সামারাবীরা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্লিনিক্যাল বিশেষজ্ঞরা সমাজের কল্যাণের জন্য এই নীতি গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু মুসলিম অধিকারকর্মী, কমিউনিটি নেতা এবং রাজনীতিবিদরা শ্রীলংকার সরকারকে এ নীতি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন।