“তিনটি বছর। অনেক সময় তাই না? হ্যা, সময়ের হিসেবে হয়ত অনেকখানি। কিন্তু আমার কাছে খুব অল্প। মনে হয়, এইতো সেদিন তার সাথে পরিচয়। আমার হাত ধরে সে বলেছিল ভালবাসি। নতুন স্বপ্ন গড়েছিলাম তার এই কথায়। কিন্তু একদিন এসে বলল, ‘তোমার সাথে থাকা আমার আর সম্ভব হচ্ছে না। আমি একটু ভাল থাকতে চাই। একা নিজের মত করে বাঁচতে চাই। আমাকে মুক্তি দাও।’
মুহুর্তের মধ্যে আমার পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। জানিনা কেন সে এমন কথা বলেছিল, তবে আমি কিছু বলতে পারিনি। কোন অভিযোগ করতে পারিনি। মুক্তি দিয়েছিলাম তাকে। আমার পৃথিবীতে আমাকে একলা রেখে সে চলে গেল। আর ফিরে এলো না।
দেখতে দেখতে তিনটি বছর পেড়িয়ে গেছে, আজও তোমার অপেক্ষায় আছি। জানো আজকের এই দিনে তোমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। মনে আছে তোমার? হয়ত নাই। কিন্তু আমি কিছু ভুলিনি। স্মৃতিগুলো আজও রাতে ঘুমাতে দেয় না। একবার ফিরে আসো। দেখে যাও কতটা ভালবাসি তোমায়। ঠিক আগের মত….”
এতটুকু লিখে আর কিছু লিখতে পারল না জামি। দু’চোখ জলে ভিজা। ডায়েরীটা বন্ধ করে রাখল। তিন বছর ধরে এভাবেই নিজের অনুভুতিগুলো ডায়েরী বন্দী করে সে। আর অপেক্ষা করে তার ফিরে আসার।
আজ আবারো সেইসব দিনের কথা মনে পড়ছে। স্মৃতির পাতার কোথাও যেন হারিয়ে গেল জামি।
ঠিক এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা নিল সে। অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করবে না চিন্তা করেও কি ভেবে রিসিভ করল, ‘হ্যালো?’
‘হ্যালো, জামি?’ অপর প্রান্তে এক মেয়েলী কন্ঠে জবাব এলো।
ও প্রান্তের কন্ঠ শুনে এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল জামির সব কিছু। কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কে বলছেন?’
‘চিনতে পারোনি আমাকে?’ – জবাব এল। ‘মনে করেছিলাম তুমি আমাকে ভুলে যাবে না। আমি সানজিদা।’
সানজিদা! তিন বছর আগে একা ফেলে দিয়ে চলে যাওয়া। আজ এতগুলো দিন পরে আবার!!! ভুল নয়ত???
কিছুক্ষণ চুপ জামি।
‘হ্যালো, জামি। শুনছ?’ সানজিদা আবার বলল।
‘হ্যা, শুনছি।’ – জামি জবাব দিল। ‘তোমাকে চিনেছি ঠিকই। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই নিশ্চিত হয়ে নিলাম।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল, ‘হঠাত কি মনে করে?’
‘তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
‘কি কথা?’
‘ফোনে বলা যাবে না। তোমার সাথে দেখা করতে চাই।’
‘কবে?’
‘আগামীকাল পাড়বে? অবশ্য তোমার কোন কাজ না থাকলে?’
‘হ্যা, পাড়ব। কোথায়?’
‘যেখানে আমরা দেখা করতাম। সেই জায়গায়?’
‘ঠিক আছে। কখন?’
‘বিকাল ৪ টার দিকে তোমার অসুবিধা আছে?’
‘না। আমি ৪টায় হাজির হয়ে যাব।’
‘তাহলে কাল দেখা হবে।’
‘হুম।’
ফোন কেটে দিল সানজিদা।
কি হল এটা? এখনো স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা বাস্তব। আজ এতগুলো দিন পর আবার তার সাথে দেখা হবে, যাকে নিয়ে জামি এখনো তার স্বপ্ন সাজায়।
পড়ুন : সাকিব আহমেদের গল্প “কাব্যকথা”
পরদিন। সময় মত বের হল জামি। পড়নে কালো পাঞ্জাবি। সানজিদা পছন্দ করে এই জামা। তাই আজ সানজিদার পছন্দমত জামা পড়েছে।
অনেক দিন পর বসুন্ধরা সিটির পথে যাওয়া। তিন বছরে একটি বারের জন্যেও সেই পথে যায়নি সে। কারন সানজিদার প্রিয় জায়গা ছিল।
বসুন্ধরা সিটির ফুড কোর্টে উঠে এলো জামি।
দু’চোখ খুঁজছে সানজিদাকে। আগে যতবার দেখা হত, প্রতিবারই দেরী হত সানজিদার। আজও হয়ত দেরী করবে।
কিন্তু তার ধারনা যে ভুল, তার প্রমান মিলল একটু পড়েই। আজ আগেই এসেছে সানজিদা। ফুড কোর্টের এক কর্ণারে একটা টেবিল দখল করে বসে আছে। একটি লাল শাড়ি পড়ে এসেছে সানজিদা। আজ অপুর্ব লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে কোন এক পরী নেমে এসেছে পৃথিবীতে। কতদিন পর আজ আবার দেখা! স্বপ্ন মনে হচ্ছে জামির কাছে। অপলক দৃষ্টিতে সানজিদার দিকে চেয়ে রয়েছে জামি।
জামিকে দেখে সানজিদা উঠে এলো।
‘হাই, কেমন আছ?’ বলল সানজিদা। সানজিদার কথায় সম্বিত ফিরে পেল জামি। তারপরও মুখে কথা নেই। চেয়ে রয়েছে সানজিদার দিকে।
‘হ্যালো, কি হল?’ আবার বলল সানজিদা। ‘এভাবে ড্যাবড্যাব করে কি দেখছ?’
‘তোমাকে।’ জামির জবাব।
‘আগে দেখ নাই?’
‘আজ নতুন করে আবার দেখছি।’
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ। তারপর সানজিদা বলল ‘চলো, বসে কথা বলি।’
কোনায় এক টেবিলে দু’জনে বসল।
‘কেমন আছ?’ প্রশ্ন করল জামি।
‘ভাল। তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে।’
‘কি কথা? আমার সাথে তোমার নতুন করে কোন কথা থাকতে পারে বলে তো জানি না।’
‘জানি আমার উপর তোমার অনেক অভিমান। অনেক অভিযোগ আছে। সব শুনব। তবে আগে আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে। আমার কথার মাঝে কোন কথা বলবে না। আমার কথা শেষ হলে তোমার কথা শুনব।’
‘শুরু কর।’
‘তুমি কি জানো কেন আমি তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম? আব্বুর জন্য। আব্বু আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছিল। আব্বু চায়নি আমি তোমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখি। আব্বু হার্টের রোগী। ডাক্তার বলেছিল কোনরকম টেনশন আব্বুর ক্ষতির কারন হতে পারে। আমার জীবনে আব্বু ছাড়া কিছু নেই তুমি জানো। আমি আব্বুর সাথে কোরিয়া চলে গিয়েছিলাম। তোমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই ছিলাম এতগুলো বছর। তোমাকে আমি এসব কিছু জানাইনি কারন আমাকে নিয়ে তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম আমাকে ঘৃণা করে তুমি আমাকে ভুলে যাও। আমার থেকে দূরে থেকে তুমি ভাল থেকো, এটাই আমার একমাত্র চাওয়া ছিল।’
এতটুকু বলে থামল সানজিদা। জামি নিশ্চুপ। বুঝতে পাড়ছে সানজিদার এখনো অনেক কিছু বলার আছে। তাই নিজের থেকে কিছু বলছে না। সানজিদার বাকি কথা শুনার অপেক্ষা করছে।
একটু দম নিয়ে সানজিদা আবার শুরু করল, ‘গত মাসে আব্বু মারা গেছে। আব্বু মারা যাওয়ার পরই আমি দেশে ফিরে এসেছি। আমি জানি না তুমি এখনো আমাকে ভালবাস কিনা। হয়ত খুব বেশী ঘৃণা কর। কিন্তু আমি আজও তোমাকে ভালবাসি। যা হয়েছে তার জন্য আমার করার কিছু ছিল না। আমি নিরুপায় ছিলাম। আমি আজ তোমার সাথে দেখা করেছি শুধু এই কথাগুলো বলতে। আমি বলব না আমার জীবনে আবার ফিরে আসো। তুমি যেমন আছ ভাল থাকো। আমার জীবনের সাথে আর তোমাকে জড়াতে চাই না। শুধু বলব আমাকে ক্ষমা করে দাও। প্লিজ, ক্ষমা করে দিও।’ সানজিদার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পরছে।
একটি চেয়ার টেনে সানজিদার পাশে যেয়ে বসল জামি। এক হাতে সানজিদার একটি হাত। আরেক হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে দিল। এবং বলল, ‘আমি আজও তোমাকে ভালবাসি। এতগুলো বছর তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। কেন জানি বিশ্বাস ছিল, একদিন তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে।’
কথাগুলো শুনে জামির বুকে মাথা গুঁজে দুল। যেন একটু আশ্রয় চায়। যেই আশ্রয়ে কোন কষ্ট থাকবে না। থাকবে শুধু সুখ আর ভালবাসা।
এভাবেই আবার নতুন করে ঘর বাধার স্বপ্ন দু’জনের চোখে। তারা ঠিক করেছে বিয়ে করবে। সানজিদার পরিবারে বিশেষ কেউ নেই। আর জামির পরিবারের কারো এই বিয়েতে কোন অমত নেই।
বিয়ের শপিং করতে যাবে আজ। ধানমন্ডির বিএফসিতে জামির জন্য অপেক্ষা করছে সানজিদা। খুব করে সেজেছে সে। আজ অনেকদিন পর এমনভাবে সেজেছে, জামি যাতে চোখ ফেরাতে না পারে।
এদিকে জামি অনেক উত্তেজিত আজ। সেও আজ সানজিদার পছন্দের জামা পরেছে। বাইক করে যাচ্ছে সানজিদার সাথে দেখা করতে। হঠাত সামনে থেকে একটি বাস আসছে। অনেক চেষ্টা করল বাসটাকে কাটিয়ে যাওয়ার। কিন্ত……
ওদিকে জামির জন্য অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে উঠছে সানজিদা। কি হল? এত দেরী তো করে না। ফোন দিল জামিকে। কিন্তু ফোন সুইচ অফ বলছে। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে, জামি আসছে কিনা। এমন সময় সানজিদার ফোনে কল আসল। খুব দ্রুত রিসিভ করল, ‘হ্যালো?’
‘হ্যালো, সানজিদা?’ অপর প্রান্ত থেকে জবাব এলো।
‘কে?’
‘আমি অনু। জামির বন্ধু। তুমি একটু হাসপাতালে আসতে পারবে?’
‘কেন? কি হয়েছে?’ কোন অঘটনের আশংকায় সানজিদার বুক কেঁপে উঠল।
‘জামির একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমরা ওকে……’
আর কিছু শুনতে পারল না সানজিদা। এতটুকু শুনার পর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। সারা শরীর কাঁপছে তার। কোনমতে একটা রিক্সা নিয়ে হাসপাতালে গেল। হাসপাতালে যেয়ে যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। জামির বন্ধুদের কান্না আর চোখের পানি সব কিছু বলে দিচ্ছিল। আর কিছু নেই, সব শেষ। স্ট্রেচারে করে জামি কে নিয়ে আসা হল। সাদা কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা। কাঁপা হাতে কাপড় সরিয়ে জামিকে শেষবারের মত দেখে কান্নায় ভেংগে পরে সানজিদা।
‘এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কত স্বপ্ন ছিল। সব এভাবে শেষ হয়ে গেল? কি দোষ করেছিলাম আমি? আমাকে ছেড়ে এভাবে কেন চলে গেলে কি নিয়ে বাঁচব আমি??? কি নিয়ে?’ সানজিদার এই আকুতি আর পূরণ হবার নয়। মৃত্যু ভয়ংকর। যার কাছে সব কিছুই হার মানে।
পড়ুন : সাকিব আহমেদের গল্প “নয়নরাঙা”
কয়েকদিন বাদে। জামির তিন বছর ধরে লিখা ডায়েরীটা সানজিদার হাতে তুলে দিল জামির এক বন্ধু। ডায়েরীর প্রতিটি পাতা পড়ছে আর দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে পরছে। ডায়েরী পড়া শেষ হলে নিজে কিছু কথা লিখল,
“সব সুখ সবার সয় না। স্বপ্নগুলো একটু একটু করে ভেংগে যায়। কিছু করা যায় না। পাওয়া না পাওয়ার বেড়াজালে আমরা সবাই আবদ্ধ। নিঃস্ব আমি। আজ সব কিছুতেই আমি একা। একার পথেই বেঁচে থাকব, আর ভালবেসে যাব। শুধু তোমাকেই…..”
পেপারস লাইফ/গল্প/সাকিব আহমেদ