করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই মধ্য এশিয়ার দুই বৈরী প্রতিবেশী আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে।
১০ই জুলাই থেকে আর্মেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমে তাভুশ সীমান্তে দুই দেশের সেনারা ট্যাংক ও কামানের মতো ভারী অস্ত্র নিয়ে লড়াই করছে।
আজারবাইজানের সরকারি হিসাবে দেশটির একজন মেজর জেনারেল র্যাংক-এর কর্মকর্তাসহ তাদের ১১ সেনাসদস্য মারা গেছে।
আর্মেনিয়া স্বীকার করেছে, একজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেনসহ তাদের চার সেনা মারা গেছে। যদিও আজেরিরা দাবি করছে, প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা ‘শত শত’।
দুই পক্ষই বলছে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতেও গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে, যাতে মানুষজন মারা যাচ্ছে।
এদিকে আজারবাইজান আর্মেনিয়ার পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। রুশ পত্রিকা প্রাভদা আজারবাইজান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কর্নেল ভাজিফ দারগিয়াখিলকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, আজারবাইজানের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে কোনও স্থাপনায় হামলা হলে আর্মেনিয়ার মেটসামোর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হবে।
ওই মুখপাত্র বলেন, ‘আর্মেনিয়া যেন মনে রাখে যে আমাদের সেনাবাহিনীর হাতে এমন ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে যা নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম। আমাদের কোনও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিশেষ করে মিনগেচভিক জলাধারে আঘাত করলে তাদের ট্রাজেডি ভোগ করতে হবে।’
মঙ্গলবার রাতে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে দেওয়া বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নামে। এ সময় তারা আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর দাবি জানায়।
জাতীয় পতাকা নিয়ে মানুষজন স্লোগান তুলেছে, ‘নাগোরনো কারাবাখ আজারবাইজানের’, ‘দ্রুত সেনা পাঠাও।’ এ ধরনের পরিস্থিতির পর আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য দুই দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, তার দেশ এ ঘটনায় খুবই উদ্বিগ্ন। তিনি দুই দেশের মধ্যে দ্রুত শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, আজারবাইজানকে রক্ষায় তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নাগোরনো কারাবাখ নামে বিতর্কিত একটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুসলিম আজারবাইজান ও খ্রিস্টান আর্মেনিয়ার মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। এই দুই দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, তখনও নাগোরনো কারাবাখ নিয়ে তাদের বিরোধ ছিল।
সে সময় অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ হিসাবে থাকলেও এখানকার জনসংখ্যার সিংহভাগই জাতিগতভাবে আর্মেনিয়, আর সেটাই সমস্যার মূলে।
সোভিয়েত আমলে নাগোরনো কারাবাখ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার পর ১৯৮৮ সালে আজারবাইজান নাগোরনো কারাবাখের আঞ্চলিক সরকারকে উৎখাত করে। এর সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার জাতিগত আর্মেনিয়রা কার্যত বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। নাগোরনো কারাবাখের আঞ্চলিক পার্লামেন্ট ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক ভোট করে আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয়ে যায় ওই এলাকার আজেরি ও আর্মেনিয়দের মধ্যে জাতিগত সংঘাত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর ১৯৯২ সালের শীতে জাতিগত ওই সংঘাত স্বাধীন আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে পুরাদস্তুর যুদ্ধে রূপ নেয়। রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধে আজারবাইজান থেকে প্রায় আড়াই লাখের মত জাতিগত আর্মেনিয়কে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। অন্যদিকে নাগোরনো কারাবাখ ছাড়তে হয়েছিল প্রায় লাখ খানেক আজেরিকে।
রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ১৯৯৪ সালের মে মাসে যুদ্ধবিরতি হলেও আর্মেনিয়া নাগোরনো কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়ে সেখানে জাতিগত আর্মেনিয়দের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়।
নাগোরনো কারাবাখ আজারবাইজানের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অংশ হলেও এটির নিয়ন্ত্রণ আর্মেনিয়ার হাতে যা আজেরিরা কখনও মেনে নেয়নি।
ফলে যুদ্ধবিরতি মাঝে মধ্যেই ভেঙ্গে পড়ে এবং ২০১৬ সালে দুই দেশের মধ্যে চারদিনের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয় যা রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের হস্তক্ষেপে থেমে যায়।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চার বছর বাদে আবারও পুরাদস্তুর একটি যুদ্ধ লেগে যাওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছে।
১৯৯৪-তে যুদ্ধবিরতির পর থেকে ‘মিনস্ক গ্রুপ‘ নামে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের কূটনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল নাগোরনো কারাবাখ সংকট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আপোষ মীমাংসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিবিসি-র ককেশাস অঞ্চল বিষয়ক সংবাদদাতা রেয়হান দিমিত্রিভ বলছেন, গত তিন দশক ধরে পরিস্থিতির কোনও অগ্রগতি না হওয়া নিয়ে আজারবাইজানের মধ্যে হতাশা দিন দিন বাড়ছে।
তিনি বলেন, ‘আজেরিরা দেখছে যে যুদ্ধের প্রায় তিন দশক পরও নাগোরনো কারাবাখ এবং আজারবাইজানের কমপক্ষে সাতটি দখল হয়ে যাওয়া এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে আর্মেনিয়া।’
গত সপ্তাহে আজেরি প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ খোলাখুলি বলেন, আন্তর্জাতিক এই মীমাংসা অর্থহীন। তার দুদিন না যেতেই সীমান্তে শুরু হয় এই লড়াই-সংঘাত।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নব্বই দশকের তুলনায় আজারবাইজানের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এখন অনেকটাই বেড়েছে। ২০১৭ সালে আজারবাইজান সামরিক খাতে যে ব্যয় করেছে তা আর্মেনিয়ার পুরো বছরের বাজেটের সমান। ফলে, আজেরিদের মধ্যে নাগোরনো কারাবাখের বাস্তবতা পরিবর্তনের সংকল্প জোরালো হচ্ছে।