সৈয়দা ইসরাত জাহান ইলমীর গল্প “শিহরণ”


bdnews24 bangla newspaper, bangladesh news 24, bangla newspaper prothom alo, bd news live, indian bangla newspaper, bd news live today, bbc bangla news, bangla breaking news 24, prosenjit bangla movie, jeeter bangla movie, songsar bangla movie, bengali full movie, bengali movies 2019, messi vs ronaldo, lionel messi stats, messi goals, messi net worth, messi height


পানির কলকল শব্দে চোখ খুললাম। নিজেকে আবিষ্কার করলাম ছোট একটা নৌকায়। উঠে বসতেই নৌকাটা দুলে উঠলো। চারপাশে শুধু রক্ত লাল পদ্ম আর নীল শাপলা। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। জনমানব শূন্য এলাকা। আমি ছাড়া আর কাওকেই দেখতে পাচ্ছি না।

হঠাৎ মাথায় একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। চারপাশ টা ঝাপসা লাগছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। কি অদ্ভুত! আকাশটা আস্তে আস্তে কালো অন্ধকার মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো কালো একটা মেঘের ভেলায় করে আমিও ভাসছি।

আবার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু আমার স্বপ্নগুলো এতো বাস্তব মনে হয় কেন? একটা হাত নৌকার বাইরে রাখলাম। আঙ্গুলগুলো পানি ছুঁয়েছে। উষ্ম পানি। ঝড়-বৃষ্টি নামার আগে নাকি পুকুর-নদীর পানি গরম হতে থাকে। আর তাই মাছ উপরে ভেসে আসে। আম্মু বলতো এই কথা।

পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি পদ্ম ফুলের আড়ালে একটা পানি-সাপ উঁকি দিচ্ছে। আঁতকে উঠলাম। সাথে সাথে পানি থেকে হাত সরাতেই আবিষ্কার করলাম নৌকাটার যাত্রী শুধু আমি একা ন। সাথে আছে অজস্র কালো রঙের সাপ। একটার উপর আরেকটা কিলবিল করছে। ওর মধ্যে একটা ডোরা কাটা সাপ আমার পা বেঁয়ে আমার দিকে আসছে।

ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। পা ঝাড়তে গিয়ে নৌকাটা ভয়ঙ্কর ভাবে দুলে উঠলো। ব্যালেন্স রাখতে পারলাম না। নৌকা কাত হতেই পরে গেলাম পানিতে। কালো-নিকষ পানি। হারিয়ে যাচ্ছি আমি সেই অতল-গভীরে।

পড়ুন : সাকিব আহমেদের গল্প “কাব্যকথা”

: ও দাদুরে… ওঠ!! হায় আল্লাহ ! আমার কলিজার টুকরাটারে ফিরাইয়া দাও আল্লাহ।

পরিচিত কণ্ঠের আর্তনাদ শুনে চোখ খুললাম। সব ঝাপসা দেখছি। চোখ বন্ধ করে আবার খুলে দেখার চেষ্টা করলাম। দাদুর কোলে শুয়ে আছি। পাশ থেকে কে যেন আমার মাথায় বারবার পানি দিচ্ছে আর দাদু অঝোরে কান্না করছে।

: চোখ খুলসে! চোখ খুলসে! মাইয়ার জ্ঞান ফিরসেগো খালাম্মা!

এতক্ষণে চিনতে পারলাম। আমার মাথায় পাশের বাড়ির ঝুমুরের মা পানি দিচ্ছিল। দাদু কান্না থামিয়ে আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসলাম। প্রচণ্ড ব্যথা। দাদুর চোখ আবারও ছলছল হয়ে উঠল। আমাকে জড়িয়ে ধরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাল।

: দাদু কি হয়েছে? আমি এখানে কেন?

দাদু উওর দিতে পারে না। আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে কোথাও কোনো ব্যথা পেয়েছি কি না। তারপর আবার বুকে টেনে নেয়। আমিও আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। এরকম আজ প্রথম হয়নি। এর আগেও এমন অনেক হয়েছে। প্রতিবারই কোনো না কোনো ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি। সাপ, কুকুর কিংবা কোন কালো ছায়ার। তারপর যখন জ্ঞান ফিরে তখন দাদুকে সামনে দেখি কান্নারত অবস্থায়। আজও একই। দাদুর কোলে মাথা রেখে পানি ঢালায় দাদুর অর্ধেকটা শাড়ি ভিজে গেছে। বাবা, মা নেই। দাদাও নেই। দাদুর একমাত্র এই আমিই আছি। জানি না শুধু আমার সাথেই কেন এমন হয়।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। আমি ঝুল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। অস্থির লাগছে। বাঁ হাতের বাহুতে বাধা তাবিজ টা খুলে হাতে নিলাম। হুজুর বলেছেন কেউ নাকি সম্পত্তির লোভে আমাকে জাদু করে মারার চেষ্টা করছে। বিশাল এই জমিদার বাড়ির একমাত্র মালিক হিসেবে আমিই আছি। এই সম্পত্তির উপর অনেকেরই লোভ। ঠিক কে এমনটা করতে পারে কেউই জানিনা আমরা। বড় একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়তেই পেছন থেকে দাদুর ডাক শুনলাম।

: সন্ধ্যা রাতে বাইরে থাকতে নেই। ঘরে চলে আয়। মাথায় তেল দিয়ে দেই।

হুজুরের ফুঁ দেওয়া তাবিজ, তেল কোনোটাই কাজে লাগে না। তবু কোনো প্রকার কথা না বাড়িয়ে লক্ষী মেয়ের মত দাদুর সামনে এসে বসলাম। তেল দিতে একটুও ভালো লাগে না আমার কিন্তু দাদুর নরম হাতে বিলি কেটে দেওয়াটা খুব ভালো লাগে। মনে মনে ঠিক করলাম, এভাবে আর থাকা যায় না। এর একটা শেষ বের করতে হবে। আর কত দাদুকে কষ্ট দিব? আজ রাতেই বের হব।

: এত কি ভাবছিস?

:হু? কিছু না দাদু। তোমার হাতে বিলি কাটা অনেক আরাম লাগে।

পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারি দাদুর ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটেছে।.. আজ পাঁচ বছর হল। বাবা-মা মারা গেছেন। মনে পরলেই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। বাঁচতে ইচ্ছা করে না আর। কিন্তু আমি চলে গেলে দাদুকে দেখবে কে?

পড়ুন : সাকিব আহমেদের গল্প “নয়নরাঙা”

দাদু ঘুমিয়ে পরেছে কি না ভালোভাবে দেখে চুপিচুপি বেরিয়ে পরি বাসা থেকে। সাইকেলের টর্চ জ্বালিয়ে রওনা দেই জঙ্গলের পেছনের রাস্তা দিয়ে। এই রাস্তা সচরাচর গ্রামের লোকেরা ব্যবহার করে না। আর এই গভীর রাতে তো এর ধারে কাছেও আসে না। ভূতের ভয়ে।
রাস্তার দু’ধারের গাছ আর রাতের আকাশের চাঁদ মিলে অন্য রকম এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সাইকেলের গতি কিছুটা কমালাম।

খোলা চুলে সাইকেল চালাতে বেশ লাগছে। হঠাৎ মনে হল, পেছনে ফেলে আসা গাব গাছ থেকে কিছু একটা আমার দিকে তেড়ে আসছে। আচমকা সাইকেল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল আমাকে। গড়িয়ে অনেকটা দূর গিয়ে পরলাম। হাত পা ছিলে গেছে। সামনে তাকাতেই বুকের হৃৎপিণ্ডটা গলায় চলে আসল। উঠে দৌড়াতে শুরু করলাম। ওটা পিছু নিয়েছে। খুব কাছে চলে এসেছে ওটা। পাগলপ্রায় আমি না পেরে হোঁচট খেয়ে পরলাম। শুকনো গলায় জোরে জোরে আয়তুল কুরসি পড়া শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি ওটা আর নেই।
উঠে দাঁড়ালাম। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছি। ভয় পেয়ে হার মানলে চলবে না। মচকে যাওয়া পা নিয়েই সামনে এগুলাম। আল্লাহ সাথে থাকলে আবার কিসের ভয়?

কিছু দূর হাটতেই সেই পুকুরের দেখা মিলল। ঠিক স্বপ্নের মত। মনে মনে জানতে পেরেছিলাম এখানেই আমি সব সমস্যার সমাধান পাব। পুকুরের পারে নেমে আসতেই দেখতে পেলাম সেই ছোট্ট নৌকা। উঠে বসলাম। বইঠা বাইতে থাকলাম। প্রচণ্ড রকম ঘামছি, সাথে পরে গিয়ে যে ব্যথা পেয়েছিলাম সেটা তো আছেই। কিছু দূর যেতেই নৌকা আর বাইতে হলো না। বাতাসে একাই চলছে। আমি বৈঠা উপরে তুলে আনলাম। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। মাথার উপর অর্ধেকটা চাঁদ মেঘের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না শুরু করলাম। চিৎকার করে বলতে লাগলাম, কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছ? তোমাদের কি আল্লাহর ভয় নেই?

আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু পারলাম না। গলা আটকে গেছে। চারিদিক নিশ্চুপ। কোনো আওয়াজ নেই। আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করার আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরত আসছে। হঠাৎ মনে হল পানির নিচ থেকে কিছু একটা নৌকাটা কে আটকে ধরেছে। ভয়ে চুপসে গেলাম আমি। দুরুদুরু বুকে নিচের দিকে উঁকি দিতেই নিচের থেকে কিছু একটা নৌকাটাকে এপাশ ওপাশ ঝাঁকাতে শুরু করল। আমি নৌকার দুইপাশ ধরে চিৎকার শুরু করলাম। মনে মনে শুধুই আল্লাহ কে ডেকে চলেছি।

জানি না কতক্ষণ এমনটা চলল। তবে এক পর্যায়ে নৌকা দোলা বন্ধ হল। আর নিচ থেকে একটা শোল মাছ লাফিয়ে নৌকায় এসে পরলো। শোল মাছের গায়ে তাবিজের মত কিছু একটা বাধা। আমার সাড়া শরীরে আর এক ফোঁটাও শক্তি নেই। নৌকাতেই জ্ঞান হারালাম।

যখন জ্ঞান ফিরল, তখন আমি নিজের রুমে শুয়ে আছি। আমাকে ঘিরে আরও অনেকেই আছে। দাদু আর একজন হুজুরও আছেন। নতুন হজুর। খুব সম্ভবত দাদু শহর থেকে যাকে আসতে বলেছিল, ইনিই সেই।

হুজুর : চিন্তার কোনো কারণ নেই। দু’টো তাবিজই নষ্ট করা হয়ে গেছে। আল্লাহর অশেষ রহমত যে আপনার নাতনি এভাবে অক্ষত অবস্থায় ফেরত এসেছে। আর দয়া করে ওকে আর কোন তাবিজ পরাবেন না। আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। উনিই সব সমস্যা সমাধানের মালিক।

দাদু কৃতজ্ঞতার চাহনি হুজুরের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল। আমি নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুজলাম। মাথার সেই অসহ্য ব্যথা এখন আর নেই। সব কিছুর জন্য আল্লাহ কে হাজার শুকরিয়া।

পেপারস লাইফ/গল্প/সৈয়দা ইসরাত জাহান ইলমী