লিখেছেন : রেহনুমা রুবায়েত প্রাপ্তি
বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর পুরান ঢাকা। এই ঢাকার আছে ঐতিহ্য। ঢাকা বলতে এখন আমরা পুরান ঢাকা, নতুন ঢাকা এভাবে বুঝি। নতুন ঢাকা নতুনই থাক। আসি পুরান ঢাকার কথায়।
❛আব্বে হা লা কী হইছে❜, ❛এমুন করতাছস ক্যালা❜!
পুরান ঢাকার ভাষা অন্যতম এক আকর্ষণীয় ভাষা। পরিচিত গন্ডির মাঝে কেউ ঢাকাইয়া হলে তার মুখ থেকে এই ভাষা শোনার জন্য মুখিয়ে থাকতাম একটা সময়। পুরান ঢাকা বলতেই আমার কাছে তাদের ভাষা, বিরিয়ানি, বাকরখানির কথা মনে হয়। অনেক ইতিহাস আর ঐতিহ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে। তারই অল্প কিছু নিয়ে একটু কথাবার্তা বলব –
পুরান ঢাকা পূর্ব-পশ্চিমে গেন্ডারিয়া ফরিদাবাদ থেকে হাজারীবাগ ট্যানারি মোড় পর্যন্ত এবং দক্ষিণে ঢাকা সদরঘাট থেকে নবাবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। একসময় অত্যন্ত সুন্দর, পরিকল্পত এবং ছিমছাম একটি শহর ছিল পুরান ঢাকা। কিন্তু কালক্রমে সেই সৌন্দর্য ম্লান হয়ে আসছে। অবশ্য এর পিছনে আমরাই দায়ী। ঐতিহ্যের এলাকার দেখভালে ঢিল দেয়া এবং আমাদের অবহেলাই পুরান ঢাকার শ্রী কমিয়ে দিচ্ছে।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ঢাকার নামকরণ নিয়ে বেশ কিছু ইতিহাস আছে। রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত জঙ্গলে হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ অঞ্চলে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো তাই রাজা বল্লাল সেন মন্দিরের নাম রাখেন ❛ঢাকেশ্বরী মন্দির❜। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম হয়ে ওঠে ❛ঢাকা❜। আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকাকে সুবাহ্ বাংলার রাজধানী রূপে ঘোষণা করেন; তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ নগরে ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবং তা থেকেই নগরের নাম ❛ঢাকা❜ হয়ে যায়।
পুরান ঢাকার বেশ কিছু বিখ্যাত স্থান আছে। বর্তমানে যাকে আমরা ❛হাইপ❜ ওঠা জায়গা বলি আর কি। যেমন: লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বড় কাটরা, ছোটো কাটরা, আর্মেনিয়ান চার্চ, তারা মসজিদ, সদরঘাট, ঢাকেশ্বরী মন্দির, হোসেনী দালান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বিউটি বোর্ডিং, ইমরান হেরিটেজ হাউজ, ঢাকা কেন্দ্র আর আছে সকল বইপোকার প্রিয় বাংলাবাজার। এছাড়াও খাবারের জন্য বিখ্যাত হাজী বিরিয়ানি, নানা বিরিয়ানি, বিসমিল্লাহ কাবাব, বিউটি লাচ্ছি ইত্যাদি তো আছেই। এরমধ্যে থেকে কয়েকটা স্থান নিয়ে আলোকপাত করবো।
তারা মসজিদ:
রমজান মাসে বিটিভিতে আযানের পরে গজল শোনানোর পাশাপাশি বিভিন্ন মসজিদের ছবি বা ভিডিও দেখাতো। সেখানেই প্রথম তারা মসজিদ দেখি। সেই ছোটো থেকেই তারা মসজিদের প্রতি আমার আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করতো। তবে সে সময় যাওয়া হয়নি। শুধু জানতাম পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত। ছোটো বেলার ভালো লাগা থেকেই হোক আর ভাগ্যের ঘূর্ণনে হোক বাস্তব জীবনে এই পুরান ঢাকার তারা মসজিদের পাশেই আশা যাওয়া এখন বেশি। ছোটোকালের টিভিতে দেখা তারা মসজিদ যখন প্রথমবার স্বচক্ষে দেখেছিলাম অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিল।
সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এ মসজিদ নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। জানা যায়, আঠারো শতকে ঢাকার ‘মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ’-এ আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান)। ঢাকার ধণাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে, ১৯২৬ সালে, ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ ব্যবহৃত হয় মসজিদটির মোজাইক কারুকাজে।
ঢাকা কেন্দ্র:
গত বছর নাজির হোসেন লিখিত ❛কিংবদন্তির ঢাকা❜ নামক বইটা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। বইয়ের সাথে জড়িত অনেকেই তখন ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বইটির একটি কপি সংগ্রহ করার জন্য তোড়জোড় শুরু করে। তাদের দলে আমিও ছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বইটির বেশ কয়েকটি কপি ❛ঢাকা কেন্দ্র❜ তে আছে। ঠিকানা জোগাড় করে শেষমেষ স্ব-শরীরে চলে যাই বইটি বগলদাবা করতে। জায়গাটা ঘুরে দেখারও বেশ ইচ্ছা ছিল।
পুরান ঢাকার মোহিনী মোহন দাস লেনে ট্রাস্টের নিজস্ব ভূমি ও ভবনের দ্বিতীয় তলায় গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা কেন্দ্র মাওলা বখ্শ সরদার মেমোরিয়াল ট্রাস্টের একটি শাখা প্রাতিষ্ঠান। সেখানে বেশ পুরনো বইয়ের আর্কাইভ কপি রয়েছে। এছাড়াও পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহি বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে। ঢাকার বেশ কয়েকটি বনেদী পরিবারের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি সাজানো রয়েছে এখানে। পাঠকক্ষ, বই বিক্রয় কেন্দ্র ও প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে। এছাড়াও এখানের প্রধান আকর্ষণ ঢাকা বিষয়ক দুষ্প্রাপ্য ও সহজলভ্য গ্রন্থসহ জ্ঞানের অন্যান্য শাখার যাবতীয় গ্রন্থ সংগ্রহ। পাঠাগার, প্রদর্শনী কক্ষ ছাড়াও এখানে একটি বাগান রয়েছে। সাথে রয়েছে একটি ক্যাফেটেরিয়া।
সদরঘাট:
একটা সময় সদরঘাত মানেই জানতাম বরিশালের লঞ্চের আড্ডাখানা। এখানে শুধু বরিশালে যাওয়া আসা করা লোকজনই যায়। তবে ধীরে ধীরে এই সদরঘাটের সম্পর্কে জানলাম। ধারনারও পরিবর্তন হলো। বুড়িগঙ্গা নদীর এই লঞ্চঘাটে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই মানুষ আসা যাওয়া করে। এছাড়াও নৌকা ভ্রমণ করার জন্যেও তরুণ-তরুণীরা আসে। যদিও বুড়িগঙ্গার সেই পানি, মিষ্টি বাতাস বিলীন হয়ে গেছে কালের পরিক্রমায়। আশেপাশের পরিবেশ দূষণে এই নদী এখন মৃতপ্রায়।
বাংলাবাজার:
বইয়ের জগতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক নাম হলো ❛বাংলাবাজার❜। বই বিক্রি, ছাপানোসহ বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কাজের আড্ডাখানা হলো এই বাংলাবাজার। বেশিরভাগ প্রকাশনীর কার্যালয় আছে এখানে। বই পাগল পাঠক, প্রকাশক, লেখক, বিক্রেতার সমাবেশ ঘটে এই বাংলাবাজারে। মুঘল সাম্রাজ্যের আগে থেকে বিদ্যমান ছিল এই বাংলাবাজার। এখানে প্রায় ১৫০০ বইয়ের দোকান রয়েছে। একাডেমিক, নন-একাডেমিক অগণিত বইয়ের সমাহার আছে এখানে। একজন বইপ্রেমী হিসেবে বাংলাবাজার গিয়ে এতো বইয়ের মাঝে হারিয়ে যেতে অন্যরকম এক প্রশান্তি কাজ করে।
এছাড়াও, পুরান ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্য হলো ❛সাকরাইন❜। পৌষ সংক্রান্তিতে এই উৎসব পালন হয়। এটি ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হিসেবেই বেশি পরিচিত। সাকরাইনের দিন একদম সকাল থেকেই ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম পড়ে যায়। পুরান ঢাকার প্রতিটি বাড়ির ছাদ নানা আকারের, রঙবেরঙের ঘুড়িতে ছেয়ে যায়। সাথে জমপেশ ভোজন তো থাকেই। সন্ধ্যায় আতশবাজি, মুখে কেরোসিন নিয়ে আ গু ন জ্বালানোর খেলা চলতে থাকে। পুরান ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্য হিসেবে যুগ যুগ ধরে সাকরাইন পালন হয়ে আসছে।
খাবারের মাঝে বিরিয়ানি তো পুরান ঢাকার প্রতি গলিতে শোভা পায়। পুরান ঢাকার মানুষ সকালের নাস্তা করে বিরিয়ানি দিয়ে এমন কথারও প্রচলন আছে বেশ। ভোজনরসিক হিসেবে পুরান ঢাকার মানুষের আলাদা নাম আছে। এজন্য এলাকার অলিতে গলিতে আছে নানা নামের, নানা স্বাদের বিরিয়ানির দোকান। রমজান মাসে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চকবাজারের ইফতারের কথা না বললেই নয়। মুখরোচক সব খাবারের ডালা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। শামি কাবাব, সুতা কাবাব, বড়ো বাপের পোলায় খায়, বিভিন্ন আকারের জিলাপী, বুন্দিয়া সহ নানা প্রকারের খাবারের পসরা থাকে। এছাড়াও, বাকরখানি পুরান ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার। চায়ের সাথে বাকরখানি বা মিষ্টির সাথে বাকরখানি অসাধারণ এক খাবার।
পুরান ঢাকা বাঙ্গালীর এক অনন্য ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের সকলের সচেতনতা এবং একাগ্র প্রয়াস কাম্য।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া