প্রয়াণে স্মরি প্রাণের হুমায়ূন


bdnews24 bangla newspaper, bangladesh news 24, bangla newspaper prothom alo, bd news live, indian bangla newspaper, bd news live today, bbc bangla news, bangla breaking news 24


হিমু, মিসির আলি ও শুভ্র এই তিন চরিত্রের স্রষ্টা নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার ও গীতিকার। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। আজ এই যাদুকরের অষ্টম প্রয়াণ দিবস।

২০১১-এর সেপ্টেম্বের মাসে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার সময় তাঁর দেহে মলাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তিনি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়ে না-পড়ায় সহজে তাঁর চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে সম্ভব হলেও অল্প সময়ের মাঝেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১২ দফায় তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় তার অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই-এ স্থানীয় সময় ১১:২০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে এই নন্দিত লেখক মৃত্যুবরণ করেন।

জনপ্রিয় এ লেখকের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি তার ভক্তরা। হিমু, মিসির আলি ও শুভ্ররা আজও তাঁকে খুঁজে ফিরে। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ যেন মৃত্যুপুরীর রুপ ধারণ করেছিল। সারা দেশে শুরু হয়েছিল আহাজারি; বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়।

নিউইয়র্ক থেকে ২০১২ সালের ২৩ জুলাই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। এরপর বিমানবন্দর থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা-জ্ঞাপনের জন্য তার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে। শহীদ মিনারে লাখো মানুষের অশ্রুজলে ভেজা পুষ্পতে সিক্ত হন হুমায়ূন আহমেদ। এর পরের দিন তাকে সমাহিত করা হয় তাঁর প্রাণের নুহাশ পল্লীর লিচু-তলায়। সেখানেই এখন শায়িত আছেন নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবদিয়া জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর ডাক নাম ছিলো কাজল। বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা ছিলেন গৃহিণী।

১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ও ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন হুমায়ূন আহমেদ। এছাড়া ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন হুমায়ূন আহমেদ। অবশ্য পরবর্তীতে লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অধ্যাপনা ছেড়ে দেন।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে বিয়ে করেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন খানকে। হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশ আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। তাদের ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে ২০০৫ সালে। এরপর হুমায়ূন আহমেদ বিয়ে করেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে। এ দম্পতির দুই ছেলে- নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর।

‘নন্দিত নরকে’ ১৯৭২ সালে প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস তার। এটি প্রকাশের পরই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এর পর একের পর এক সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি; যা আজও পাঠকহৃদয়ে সমাদৃত। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস ‘মধ্যাহ্ন’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত।হুমায়ুন আহমেদের লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, ‘নন্দিত নরকে’, ‘লীলাবতী’, ‘কবি’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘গৌরিপুর জংশন’, ‘নৃপতি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘শুভ্র’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ প্রভৃতি। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’ ও ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’।
টিভি নাট্যকার হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় নির্মাণ করেন প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’। এ নাটকটি তাকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। এছাড়াও তার হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং সৃষ্টির অনবদ্য ইতিহাস ‘অয়োময়’ ছিলো বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। এছাড়াও তিনি নির্মাণ করেন নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে।
শুধু তাই নয়। নন্দিত এই লেখককে নিয়ে দেশের বাইরেও রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তার প্রমাণ জাপান টেলিভিশন ‘এনএইচকে’

তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছে পনের মিনিটের তথ্যচিত্র ‘হু ইজ হু ইন এশিয়া’। হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), মাইকেল মধুসূদন পদক (১৯৮৭), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) লাভ করেন।

নন্দিত এই লেখককে এখনো খুঁজে তার ভক্তরা। তরুণরা হিমু হয়ে মহাপুরুষ হতে চায়, মিসির আলী ও শুভ্র হয়ে বেঁচে থাকে। যার বই পড়ে মানুষ বইকে ভালবেসেছে সে আর কেউ নয় একমাত্র হুমায়ুন; যার লেখা আজও পাঠকের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। আর আজও এই প্রয়াণদিবসে নন্দিত এই যাদুকররে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে পাঠকসমাজ। হুমায়ুন আহমেদ আজও বেঁচে আছে পাঠকদের ভালবাসায়।