ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের শহর তামিল নাড়ুর এই গ্রামটির নাম আন্দামান। রাজ্যের রাজধানী চেন্নাই থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছোট্ট গ্রামটিতে ১৩০ পরিবারের বাস। ধানক্ষেত ঘেরা এই গ্রামের অধিকাংশই কৃষিজীবী।
আন্দামান গ্রামের প্রবেশদ্বারেই আছে প্রকাণ্ড একটি নিম গাছ। গাছটির নিচে থাকা ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকেই ধানক্ষেতগুলোতে চাষের পানি আসে। এখানকার রাস্তাগুলো পাথর দিয়ে আবৃত। বহু বছরের পুরনো এই নিম গাছটি থেকেই শুরু হয় গ্রামের মানুষদের জুতা খুলে হাতে নেয়া।
গ্রামের প্রবেশদ্বার থেকে জুতা হাতে নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেন তারা। আবার জুতা হাতে নিয়ে গ্রামের সীমানার বাইরে গিয়ে তারা এটি পায়ে দেন। অদ্ভুত রীতিনীতি মনে হলেও প্রতিদিন এমন করেই দিন পার করেন এখানকার মানুষ।
অনেক বয়স্ক ও খুব অসুস্থতা ছাড়া আন্দামান গ্রামের প্রতিটি মানুষ এই নিয়ম মেনে চলেন। এমনকি প্রচণ্ড গরমে মাটি যখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত থাকে তখনও তাদের পায়ে জুতা থাকে না। গ্রামের সীমানা পার না হওয়া পর্যন্ত সবাই জুতো হাতে নিয়ে হাঁটেন। এমনকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও স্কুলে যাওয়ার পথে এ নিয়ম মেনে চলে। খালি পায়ের এ অবস্থাতেই চলে গ্রামের কাজকর্ম।
প্রথাটি শুরুটাও ছিলো একটা বিস্ময়কর ঘটনার মাধ্যমে। গল্পের শুরুতে যার কথা না বললেই নয় তিনি ৬২ বছর বয়সী লক্ষণ ভিরাবাদরা। চার দশক আগে এই গ্রামে দৈনিক মজুরির শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি দুবাইতে একটি নিমার্ণ কোম্পানির মালিক।
এই কোম্পানিতে জনবল নিয়োগ দেয়ার জন্যে তিনি মাঝে মাঝে গ্রামে আসেন। যদিও তার গ্রামের আসার মূল উদ্দেশ্য সেটা না। শেকড়ের টানেই তিনি এই গ্রামে ছুটে আসেন।
লক্ষণ ভিরাবাদরা জানান, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগের কথা। গ্রামের প্রবেশদ্বারে ওই নিম গাছটির নিচে গ্রামের সবাই মিলে কাদামাটি দিয়ে ভগবান মুথায়ালাম্মার একটি মূর্তি তৈরি করে। পুরোহিতরা যেমন ভগবানের মূর্তি গয়না দিয়ে সাজায় এবং এর চারপাশে ঘুরে মানুষ পূজা করেন, ঠিক এভাবেই একটি যুবক জুতা পরে ভগবানের মূর্তির চারপাশে হেঁটেছিল।
তিনি বলেন, যুবকটি অবজ্ঞা করে এভাবে হেঁটেছিল কি না সেটা আজও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে হাঁটতে হাঁটতে যুবকটি পিছলে মাঝখানে পড়ে যায়। ওইদিন সন্ধ্যায়ই সে রহস্যময়ভাবে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যা সেরে উঠতে কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল। সেই থেকে অজানা ভয় এবং বিশ্বাসে গ্রামের মানুষ আর কোনো দিন জুতা পরে না। এটা এখন জীবনের স্বাভাবিক একটি অংশ।
আন্দামানের বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী মুখান আরুমুগাম জানান, বয়স্ক বা খুব বেশি অসুস্থ ছাড়া গ্রামের কেউ জুতা পরেন না। তিনিও খালি পায়েই ছিলেন। যদিও তিনি বলছেন, শীঘ্রই তিনি স্যান্ডেল পরবেন, বিশেষত গ্রীষ্মের উষ্ণ মাসগুলোতে।
তবে অনেক বহিরাগতই এখন পুরনো এই অদ্ভুত কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করছেন। তবে গ্রামবাসীরা এই বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। তারা বিশ্বাস করে এটি কুসংস্কার হোক আর নাই হোক এটি তাদের এক বন্ধনে ঘিরে রেখেছে।
রমেশ সেভাগন নামের এক গাড়িচালক বলেন, এটি আমাদের সম্প্রদায়কে দৃঢ় করতে সাহায্য করছে। একটি পরিবারের মতো আমাদের সবাইকে একই বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। এখানে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের জন্য গ্রামের প্রত্যেকে ২০ রুপি করে অনুদান দেন। এই অর্থ দেয়ার জন্য ধনী বা গরীব আলাদা করা হয় না। সবার জন্যই এই নিয়ম সমান। ভালো সময় ও খারাপ ক্ষেত্রে প্রতিবেশীদের আমরা পাশে থাকতে চাই। এটা মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা এখানে সবাই সমান।
তবে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামের মানুষদের এই বিশ্বাস ভঙ্গ করেন না গ্রাম থেকে বাইরে চলে যাওয়া মানুষগুলোও। তারা গ্রামে ফিরে এলে গ্রামবাসীদের সাথে মিলে জুতা ছাড়াই হাঁটেন। তারা চান না আন্দামানের সহজ-সরল মানুষগুলোর হৃদয়ে থাকা এই বিশ্বাসে চির ধরাতে।
রমেশ সেভাগন বলেন, ‘এই নিয়মের কারণে আমাদের মাঝে গড়ে উঠেছে সৌহার্দ্য- এমনটাই তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করে। খারাপ ভালো যে কোনো সময়েই তারা একে অপরের পাশে থাকতে পারে এই ভাবনাই তাদের একসাথে করে রেখেছে।’