ভারতবর্ষের নৃশংস এক খুনে সম্প্রদায় ‘ঠগি’


bdnews24 bangla newspaper, bangladesh news 24, bangla newspaper prothom alo, bd news live, indian bangla newspaper, bd news live today, bbc bangla news, bangla breaking news 24


ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি ভাষায় যতগুলো স্থানীয় শব্দ গ্রহণ করা হয়েছিল তারমধ্যে একটি হলো থাগ (THUG) । ইংরেজি ভাষায় থাগ শব্দটির অর্থ চোর বা ডাকাত । এই শব্দটি সংস্কৃত ঠগি শব্দ থেকে এসেছে এবং ‘ঠগ’ শব্দটি এসেছে ‘ঠগি’ থেকে, বাংলা ভাষায় যার অর্থ হলো ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক । ১৮৩৯ সালে ফিলিপ মেডোউস টেলরের লেখা ‘Confessions of a Thug’ উপন্যাসের মাধ্যমে ঠগিদের কাহিনী জনপ্রিয়তা অর্জন করে ।

ঠগিরা আসলে বিশেষ শ্রেণীর দস্যুদল, যারা হত্যাকান্ডের জন্য হলুদ রংএর একটি রুমাল ব্যবহার করতো, দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে যেটি দৈর্ঘ্যে হতো মাত্র ৩০ ইঞ্চি । রুমালের ১৮ ইঞ্চির মাথায় একটা গিট থাকতো, তাতে একটা রুপোর টাকা বা তামার ডবল পয়সা বেঁধে বিশেষ কায়দায় খুন করা হতো ।

এদের মতন নিষ্ঠুর এবং নিপুণ খুনীর দল পৃথিবীতে শুধু নয়, ইতিহাসেই বিরল । এরা যাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিত তার সামনে দাড়িয়ে গলা লক্ষ্য করে রুমালটা ছুড়ে দিত, এরফলে রুমালের ভারী প্রান্ত প্যাঁচ খেয়ে গলায় সেঁটে যেত ।

ঠগিরা সাধারণত দলগতভাবে ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রী কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমণ করতো এবং পথিমধ্যে অন্য তীর্থযাত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে তাদের সাথে মিশে যেত । এরপর কোন যাত্রাবিরতিতে তারা ভ্রমণকারীদের হত্যা করে তাদের সম্পত্তি লুটতরাজ করে মৃতদেহ কালী দেবীর নামে উৎসর্গ করতো ।

ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার ‘কালীঘাট’ ও বিন্ধ্যাচলের ‘ভবানী মন্দির’ । ঠগিরা সাধারনত বংশপরম্পরায় হত্যাকান্ড ঘটাতো । একজন ঠগি বালক ১৮ বছর বয়স হলেই তবে হত্যার অনুমতি পেতো । ঠগিরা তাদের দেবীকে বাংলায় ভবানী নামে ডাকতো । দলের সর্দারকে তারা জমাদার নামে অভিহিত করতো । হত্যা করার সময় একজন ব্যক্তিকে হত্যার জন্য তিনজন ঠগি নিয়োজিত হতো, এদের একজন মাথা ঠেসে ধরতো, একজন রুমালটি হত্যার শিকার ব্যক্তির গলায় পেচিয়ে ধরতো এবং অরেকজন পা চেপে ধরে থাকতো ।

তারা নানান সাংকেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে বাক্য আদান প্রদান করতো, যেমন- ‘বাসন মেজে আনার কথা’ বলার মধ্য দিয়ে সর্দার তার এক অনুচরকে কবর তৈরি করার নির্দেশ দিতো । ‘ঝিরনী’ শব্দে হত্যার প্রস্তুতি আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেয়া হতো । এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস জড়ানো হতো শিকারের গলায় । গোষ্ঠীভুক্ত না হলে তাদের সংকেতের পাঠোদ্ধার করা অসম্ভব । তারা বিভিন্ন ভূমিকা আর দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাদারি শ্রম বিভাজনের কাঠামো তৈরি করেছিলো । সবার আগে থাকতো ‘সোথা’রা । সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করা, তার সাথে ভাব জমানোর এবং শিকার সম্পর্কে নানান তথ্য যোগাড়ের দায়িত্ব থাকতো তাদের ওপর । পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখতো যারা তাদেরকে বলা হতো ‘তিলহাই’, তারা দল থেকে খানিকটা পিছনে থাকতো । নিরাপদ জায়গা দেখে তাঁবু গড়ার দায়িত্ব থাকতো ‘নিসার’দের ওপর । কবর তৈরি করার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতো ‘বিয়াল’ ।

শিকারকে যে ধরে রাখবে তাকে বলা হতো ‘চামোচি’। শিকার যাতে বাধা দিতে না পারে সেজন্য হাত আটকে রাখার দায়িত্ব ‘চুমোসিয়া’র । ‘চুমিয়া’ শিকারের পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে আর ‘ভোজারা’ মৃতদেহ কবরে নিয়ে যাবে । ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হলো দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেয়া ।

মৃতদেহ পাহারা দেয়া ও বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলা হতো ‘ফুরকদেনা’ আর হত্যাকাণ্ডের জায়গাটা সাফসুতরো করে ফেলার দায়িত্ব ছিলো ‘ফুরজানা’দের । সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসতো ঠগিদের অমৃতের ভোজ । ভোজ এমন আহামরি তেমন কিছু নয়, গুড়ের ভোজ । একলা পথিক পেলেই সাদরে তাকে দলের সাথে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাতো । তাদের মতে, যে একবার এই গুড় খাবে, সে ঠগি হয়ে যাবে । ঠগিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিলো ।

তবে এদের কথা প্রথম জানা যায় ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানির লেখা ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে । জানা যায় যে, ১২৯০ এর দিকে সুলতানের শাষন আমলে কিছু ঠগ ধরা পড়ে, কেউ কেউ বলে এ সংখ্যা এক হাজার । শাস্তি দেয়ার জন্য নতুন দিল্লীতে নেয়া হলে সুলতান তাদের একজনকেও হত্যা না করে নৌকায় ভরে ভাটির দেশে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দেন যাতে তারা আর কোনদিন দিল্লীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে । বাংলায় ঠগিদের ইতিহাসের সূত্রপাত সম্ভবত এখান থেকেই ।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ঠগিরা হত্যার পর লাশ কবর দিতো বা মাটিতে পুঁতে রাখতো । কেউ পালিয়ে গেলে ঠগিদের অগ্রবর্তী দল তাদেরকে হত্যা করতো । তবে তারা ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদেরকে সাধারনত হত্যা করতো না । তারা হত্যার পর মৃতদেহ একসাথে হাড় ভেঙ্গে কবর দিয়ে রাখতো যাতে পচন প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয় । ভারতে সেসময়ে এমন এক ব্যক্তি ছিল যে এরকম সাদামাটা পদ্ধতিতে সর্বমোট ৯৩১টি খুন করেছিল । তার নাম ছিল ঠগি বেহরাম । তাকে বলা হতো ‘ঠগিদের রাজা’ ।

খুন করা তার কাছে ছিল ধর্মাচারের মতো । ত্রয়োদশ শতক থেকেই ঠগিরা ভারতবর্ষে মাথাচাড়া দিয়েছিলো তবে বেহরাম ছিলো তাদের সর্বশেষ এবং সবথেকে ভয়ঙ্কর খুনি । বেহরাম যদিও ১২৫টি খুনের কথা স্বীকার করেছিল তবে তার ভাষ্যমতে সে আরও শ’দেড়েক খুনে সাহায্য করেছিলো ।

ঠগিরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো । তারা যত মানুষ হত্যা করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন । কেবল ১৮৩০ সালেই ঠগিরা প্রায় ৩০ হাজার মানুষ হত্যা করেছে । ১৮১২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঠগিদের কথা প্রথম জানতে পারে । সেসময় একটি গণকবরে ৫০টি মৃতদেহ গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো । কিছু হিসেব অনুযায়ী ১৭৪০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ঠগিরা এক মিলিয়ন এর বেশি মানুষ হত্যা করেছিলো ।

শুরুতে তীর্থযাত্রীরা নিখোঁজ হলে ব্রিটিশ শাষকরা এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনেকরলেও যখন আস্তে আস্তে ব্রিটিশরাও নিখোঁজ হতে শুরু করে তখন গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিক এর টনক নড়ে । তিনি ঠগিদের নির্মূল করতে ১৮৩০ সালে ভারতের প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে নির্দেশ দেন ।

বেঙ্গল আর্মির অফিসার উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যান ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি । তিনি দেখলেন যে কিছুতেই অন্যান্য দুস্কৃতিকারীদের থেকে ঠগিদের পৃথক করা যাচ্ছে না, কারণ তারা নিপুণ কৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিলো । শ্লীম্যান তাই গুপ্তচর নিয়োগ করলেন এবং গঠন করলেন বিশেষ পুলিশ বাহিনী ও আলাদা বিচার আদালত । পাশাপাশি ঠগিদের অপরাধস্থল বিশ্লেষণ করে তৈরি করলেন মানচিত্র । এছাড়াও তিনি অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা তৈরি করলেন যাতে পরবর্তী হত্যার সময়কাল আঁচ করা যায় । এরপর তিনি নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ সেসব স্থানে পাঠাতে থাকলেন । এভাবে ১৮৩০ সালে হেনরি শ্লীম্যানের গুপ্তচরদের দক্ষতায় ঠগিরা দলে দলে ধরা পড়তে থাকে । ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত শ্লীম্যান প্রায় ৩৭০০ ঠগিকে ধরতে সক্ষম হন ।

১৯৪০ সালের দিকে প্রায় ৫০০ ঠগির ফাঁসি কার্যকর হবার পর ঠগিদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসতে থাকে এবং যারা ধরা পড়তে বাকী ছিলো তারা ভয়ে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় । এখনো ভারতের রাজস্থানে ঠগিদের বংশধরদের দেখা যায় তবে তারা এখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে ।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট