করোনার কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত জীবনে একরকম ‘বিষফোড়া’ হয়ে আসে বন্যা। এখনো দেশের ২৫ জেলা ভাসছে বানের পানিতে। বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দারা বানের সঙ্গে লড়তে গিয়ে ভুলতে বসেছে ভয়ংকর ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের কথা। ওই সব এলাকায় করোনার চিকিৎসাসেবাও একরকম বন্ধ। এর মধ্যেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে আকাশভাঙা বৃষ্টি। থামার যেন নাম নেই!
একদিকে বন্যার পানি, অন্যদিকে ভারি বর্ষণের ফলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তলিয়ে গেছে ফসল। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। ভেঙে গেছে বাঁধ। ডুবে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট।
গবাদি পশু, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, থাকা-খাওয়া নিয়ে বানভাসি মানুষজন পড়েছে বিপদে। বন্যাজনিত রোগ, পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে ৩০ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে কষ্টে দিন পার করছে কয়েক লাখ মানুষ।
দিকে বিরামহীন বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকা তলিয়েছে। পানি উঠেছে সড়কে। জলাবদ্ধতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে নাভিশ্বাস উঠেছে রাজধানীবাসীর। টানা দুই দিনের বৃষ্টিতেই জলজটে বিরক্ত নগরবাসী। নগরের এই অব্যবস্থাপনার জন্য তারা দুষছে দুই সিটি করপোরেশন ও ওয়াসাকে। ঢাকা দক্ষিণের গেণ্ডারিয়া, বংশাল, মতিঝিল, সায়েদাবাদ, ধানমণ্ডি, জিগাতলা, শান্তিনগর এবং গ্রিন রোড এলাকায় এলাকার প্রধান সড়কে গতকালও জলাবদ্ধতা ছিল।
ঢাকা উত্তরের উত্তরা, ভাটারা, গুলশান, বাড্ডা, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের এলাকা, মোহাম্মদপুর এবং মিরপুর এলাকাও ছিল পানিতে থইথই। জলাবদ্ধতার কারণে চিকিৎসা ও পরীক্ষা করতে আসা অনেক করোনা রোগী পড়ে বিপাকে।
শুধু দেশে নয়, উজানেও ভারি বর্ষণ চলছে দুই দিন ধরে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হওয়ায় গত রবিবার থেকে টানা বৃষ্টি ঝরছে। গতকাল মঙ্গলবার দেশের প্রায় সব জেলাতেই গড়ে ৫০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টি নেমেছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টি হয়েছে ১০০ মিলিমিটারেরও বেশি।
জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে এমনিতেই দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর মধ্যাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলো বন্যায় ডুবেছে। গত দুই দিনে দেশের ভেতরে এবং উজানে ভারি বর্ষণের ফলে নদ-নদীর পানি ফের বাড়তে শুরু করেছে। ফলে ওই সব জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হচ্ছে।
দেশের ২৮টি পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশনে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে পানি বইছে। চলমান বন্যা দেশের ২৫ জেলায় বিস্তৃত হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ঘরের ভেতর পানি ঢোকায় বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার ওপর। বন্যার পানি ও ভারি বর্ষণে সুনামগঞ্জ বক্ষব্যাধি হাসপাতালে পানি ঢুকে পড়ায় গতকাল হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফলে রোগীরা পড়েছে মহাবিপদে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, ভারতের রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত মৌসুমি বায়ু বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ঠেকেছে।
আবহাওয়া অফিসে থেকে আরও জানা যায়, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এ সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতেও বৃষ্টি থাকবে। বিশেষ করে রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের সব জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে। ভারি বর্ষণও হতে পারে কোথাও কোথাও।
এ অবস্থায় বন্যাদুর্গত এলাকায় উদ্ধারকাজে গতি আনতে রেসকিউ বোট কিনছে সরকার। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের কাছ থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ৬০টি মাল্টিপারপাস অ্যাক্সিসিবল রেসকিউ বোট কিনবে। প্রতিবছর ২০টি করে তিন বছরে ৬০টি বোট কেনা হবে। প্রতিটি বোটের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা।
গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি চুক্তি সই হয়। অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী বলেন, রেসকিউ বোট বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ, গৃহপালিত পশুপাখি ও অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরের কাজে ব্যবহার করা হবে। নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের রেসকিউ বোটের মাধ্যমে নিরাপদে উদ্ধার ও স্থানান্তর কাজ পরিচালনায় বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রতিটি বোটে একটি ফার্স্ট এইড বক্স, একটি হুইলচেয়ার, একটি স্ট্রেচার, একটি ওয়াকিং ফ্রেম, দুটি আলাদা টয়লেট, যার একটি সবার জন্য উন্মুক্ত এবং অন্য একটি সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য ব্যবহার করা যাবে। প্রতি বোটে ৮০ জন যাত্রী ছাড়াও গৃহপালিত পশুপাখি ও অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বহন করা যাবে।