করোনা প্রকোপের কারণে এমনিতেই জনজীবন বিপর্যস্ত তার মধ্যে যদি থাকে চাকরি বাঁচানোর তাগিদ তাহলে সবমিলিয়ে অতি দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় সেটি।
এবার এমনই এক ঘটনা ঘটেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটে। বসিরহাট থেকে ডালহৌসি, ট্রেনে-বাসেই দূরত্ব প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। লকডাউনের কারণে ট্রেন বন্ধ, বাসও নেই। কিন্তু অফিসে পৌঁছতে হবে।
তাই দু’চাকার সাইকেলই বেছে নিয়েছিলেন পঞ্চান্ন বছর বয়সি সঞ্জয় বিশ্বাস। চাকরি বাঁচাতে আসা-যাওয়া মিলিয়ে ১৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পরিশ্রম চলছে এখনও। মঙ্গলবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অস্থায়ী কর্মী বুঝেছেন, সহসা তাঁর নিস্তার নেই!
স্ত্রী, মেয়ে নিয়ে সংসারে তাঁর আয়টুকুই সম্বল। জমানো টাকা দিয়ে বছরখানেক হল বাড়িটা দাঁড় করিয়েছেন। কাজ করতে ডালহৌসির নেতাজি সুভাষ রোডের স্টেট ব্যাঙ্কের অফিসে যান, কিন্তু চাকরিটা সরকারি নয়। একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, ব্যাঙ্কে টেবিলে টেবিলে ফাইল চালাচালির কাজ। অফিসে যেতে না-পারলে চাকরি বাঁচানো কঠিন।
গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার কোন উপায় নেই তাঁর। নেই দু’চাকাও। পরে একটা পুরোনো সাইকেল জোগাড় করেন। লকডাউনের রাস্তায় সেটাই সঞ্জয়ের বাহন।
অফিসে পৌঁছতে হয় সকাল সাড়ে ৯ টার মধ্যে। তাই ৭৫ কিলোমিটারের রাস্তা পেরোতে রাত ৩ টায় বেরিয়ে পড়েন তিনি। বয়স হয়েছে, বেশি জোরে চালানোর ধকল নিতে পারেন না।
একটাই সুবিধা, লকডাউনের জন্য রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া কম। টাকি রোড ধরে বারাসত পৌঁছে সঙ্গী হিসেবে পান সহকর্মী বিষ্ণু মল্লিককে। তা-ও কিছুটা দূর হয় একাকিত্ব।
বিরাটি থেকে ওই দলে যোগ দেন আর এক সহকর্মী উত্তম দাস। তার পর যশোর রোড ধরে শ্যামবাজার হয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে গিয়ে পড়েন। শেষে লালবাজার হয়ে সোজা অফিসে। বিকেলে আবার ফিরতি পথ। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যায় ঘড়িতে।
মঙ্গলবার সাতসকালে মধ্যমগ্রামের কাছে পাওয়া গেল সঞ্জয়কে। সাইকেলের সামনে দড়ি দিয়ে বাঁধা ব্যাগ। বুকে ঝোলানো পরিচয়পত্র। শুধু বললেন, ‘চাকরিটা চলে গেলে একেবারে অচল হয়ে যাব।
হাত আর পা দুটোই সব। বাকিটা মনের জোরে চালিয়ে নিই।’ পথে বিপত্তি কম নয়। একদিন দোলতলার কাছে টায়ার পাংচার হয়ে যায়। সাইকেল ঠিক করার দোকান খুঁজে পান বারাসত স্টেট জেনারেল হাসপাতাল পেরিয়ে। সে দিন রাতে বাড়ি ফেরেন বারোটার পর।
দুশ্চিন্তা হয় না স্বামীর জন্য? সঞ্জয় বের হবেন বলে রাত দেড়টায় উঠে রান্না চাপাতে হয় স্ত্রী ছবিকে। তার পর সারা দিনের অপেক্ষা। ফোনের ওপার থেকে ছবি বলেন, ‘চিন্তা হয়, তবু উপায় নেই। চাকরিটা চলে গেলে না খেয়ে মরবো। ফোনে সবসময় খোঁজ রাখি।’
সঞ্জয়ের প্রশংসায় করে ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রথমে জানতাম না, উনি এতটা পথ সাইকেল চালিয়ে আসছেন! খুবই পরিশ্রমী মানুষ। আমাদের সকলের কাছে উনি উদাহরণ।’
অল ইন্ডিয়া স্টেট ব্যাঙ্ক অফিসার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৌম্য দত্ত বলেন, ‘ব্যাঙ্ককর্মীরা যে ভাবে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন, তা অন্য ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের ভাষণে আমাদের করোনা যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।