সাকিব আহমেদের গল্প “আবার নয়নরাঙা”


bdnews24 bangla newspaper, bangladesh news 24, bangla newspaper prothom alo, bd news live, indian bangla newspaper, bd news live today, bbc bangla news, bangla breaking news 24, prosenjit bangla movie, jeeter bangla movie, songsar bangla movie, bengali full movie, bengali movies 2019, messi vs ronaldo, lionel messi stats, messi goals, messi net worth, messi height


পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেছে। এই পাঁচ বছরে বদলেছে অনেক কিছু। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই বদলে গেলেও বদলে যায় নি একটি সম্পর্ক। নয়ন আর রাঙার বন্ধুত্বটি ঠিক আগের মতোই আছে। বরং আরও যেন মজবুত হয়েছে বন্ধুত্বের বাঁধন।

পাঁচ বছর আগে যেদিন আমেরিকার উদ্দেশ্যে চলে গিয়েছিল নয়ন, খুব কেঁদেছিল রাঙা। রাঙার মনে হয়েছিল, পুরো পৃথিবী তার আলাদা হয়ে গিয়েছে। নয়নকে অনেক অবহেলা করেছে সে। এই অবহেলার মূল্যে সে হারিয়েছে প্রিয় বন্ধুটিকে। সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি বিদেশ চলে যাওয়ার মুহূর্তে নয়নকে জড়িয়ে রাঙার সে কি কান্না! সে কান্নায় পাথরও হয়ত গলে যাবে। কিন্তু গলেনি নয়নের মন। রাঙার কান্নায় উথাল পাতাল হওয়ার পরও ইস্পাতের চেয়েও কঠিন মন নিয়ে চলে গিয়েছিল নয়ন।

সাকিব আহমেদের গল্প “নয়নরাঙা”

নয়নের চলে যাওয়ার পর রাঙা বুঝতে পেরেছিল নয়ন ছাড়া সে অচল। নয়নের অস্তিত্ব ছাড়া সে কিছুই না। অথচ নয়ন থাকাকালীন এই উপলব্ধি কখনো হয়নি। কখনো বুঝেইনি, নয়ন ছাড়া সে থাকতে পারবে না। চলতে পারবে না। এই জন্যই হয়ত অনেকে বলে, মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝে না।

এই পাঁচ বছরে এমন একদিনও যায়নি, রাঙার সাথে নয়নের কথা হয় নি। রাঙার বিয়ে হয়েছে গত বছর। সেদিনও সে কথা বলেছে নয়নের সাথে। ভিডিও কলে নিজের সদ্য বিয়ে করা হাজবেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নয়নের সাথে। প্রথম দিনের কথাতেই নয়নের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে সেলিমের।

সেলিম রাঙার হাজবেন্ড। সেদিন সেলিম বুঝতে পেরেছিল, রাঙার কাছে তার অস্তিত্ব যতটুকু নয়নের অস্তিত্ব তার চেয়ে ঢের বেশি। প্রথম প্রথম এ নিয়ে অভিযোগ থাকলেও, পরে সেলিম ঠিকই বুঝতে পেরেছিল এই বন্ধুত্ব খাঁটি। তার কোনো এখতিয়ার নেই যে বন্ধুত্বের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। তাই সেও মেনে নিয়েছে একসময়। এমনকি, নয়নের সাথে নিজের বন্ধুত্বও মজবুত করে নিয়েছে।

এখন তিনজন মিলে আড্ডা দেয়, গল্প করে। ভিডিও কলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেয়। রাঙা না থাকলে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে একা একা সময় পার করতে থাকলে বিষণ্ণতায় ভুগত নয়ন। পরে সেলিম এসে তার জন্য যেন সাপে বর হয়েছে। নয়ন সবসময় ভাবতো রাঙার হাজবেন্ড এমন একজন হবে যার সাথে তারও বন্ধুত্ব থাকবে। কখনো রাঙা-নয়নের এই বন্ধুত্বের বন্ধন নিয়ে সন্দেহ করবে না, অভিযোগ করবে না। নয়নের সেই ইচ্ছেই যেন পূরণ হয়েছে। রাঙা ও নয়নের বন্ধুত্বে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি সেলিম।

পাঁচ বছর পর আজ নয়ন দেশে ফিরছে। গত বছর রাঙার বিয়ের সময় দেশে ফেরার ইচ্ছা থাকলেও সে সময় পেরে উঠেনি। অনেক চেষ্টা করেও নিজের বেস্টফ্রেন্ডের বিয়েতে থাকতে পারেনি নয়ন। সেই সময় প্রচণ্ড মন খারাপ হলেও, মেনে নিয়েছে। মানিয়ে নিয়েছে। আজ এতগুলো বছর পর দেশে ফিরেছে নয়ন। সময়ের হিসেবে মাত্র পাঁচ বছর হলেও নয়নের কাছে তা এক যুগের চেয়েও বেশি। এই দেশের মাটি তাকে টানে। এ দেশের আলো বাতাস সে ভীষণ মিস করে। আজ তাই খুব খুশি নয়ন। নিজের ঘরে ফিরছে যে!

‘কি গো, তোমার হলো?’ সেলিমের চিৎকার শুনে ফিরে তাকালো রাঙা। একবার তাকিয়েই আবার ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকালো। সাজগোজ করায় মন দিলো।

‘আর কতো সাজবে?’ আবার বলল সেলিম। ‘তোমার সাজতে সাজতেই তো নয়ন চলে আসবে। তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয় না?’ রাঙা সাধারণত খুব একটা সাজে না। তবে আজ সাজছে। মনের মতো করে সাজছে। সাজছে নয়নের জন্য। নিজের বেস্টফ্রেন্ডের জন্য কেন এমনভাবে সাজছে, রাঙা নিজেও জানে না। সেলিমের মাঝে মাঝে মনে হয়, রাঙা ও নয়নের কোনো এক অজানা সম্পর্ক আছে। যা হয়ত তারাও জানে না।

এ সম্পর্কের বেড়াজালে তারা আবদ্ধ সেলিমও। বন্ধুত্বের বাইরে থাকা সে সম্পর্কের অপূর্ণতা বুঝে সেলিম। কিছু বলে না। কেননা, এই এক বছরের কম সময় দুইজনকে যতটুকু দেখেছে, বুঝেছে, কখনো বিশ্বাস ভঙ্গের কিছু হয় নি। রাঙাকে সে বিশ্বাস করে, বোধহয় নিজের চেয়েও বেশি। নয়নকেও অবিশ্বাস করতে পারে না। অবিশ্বাস করার মতো কোনকিছুই যে তারা করেনি। কিভাবে অবিশ্বাস করবে?

সাকিব আহমেদের গল্প “অনলাইন এক্সাম”

আজ শুক্রবার। অফিস ছুটি। তাই নয়নকে আনতে যেতে বাঁধা নেই সেলিমের। সেই রাঙাকে বলেছে, রাঙাকে নিয়ে নিজে যাবে এয়ারপোর্ট। নয়নকে নিয়ে আসবে। নিজের বিয়ে করা বউয়ের খুশির জন্য এ কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া নয়নকে দেখার কৌতূহল তো আছেই। আছে সামনাসামনি পরিচিত হওয়ার আগ্রহ। ভিডিও চ্যাট বা ফোনে আড্ডা দিলেও সামনে থেকে পরিচয় হওয়ার অনুভূতিই অন্যরকম। রাঙার কাছে নয়নের অনেক গল্প শুনেছে সেলিম। সেই থেকেই আগ্রহ বেড়েছে, সাথে বেড়েছে কৌতূহল।

‘আমি রেডি।’ বলল রাঙা। আজ রাঙাকে অপূর্ব লাগছে। লাল শাড়িতে ঠিক যেন পরীর মতো লাগছে রাঙাকে। চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে সেলিম। চোখ ফেরাতে পারছে না যেন। রাঙার বিয়ের সময় লাল শাড়ি পড়া রাঙাকে দেখতে পারে নি নয়ন। তাই, আজ নয়নকে সারপ্রাইজ দিতে লাল শাড়ি পড়েছে।

‘কি দেখছ এভাবে?’ সেলিমকে জিজ্ঞেস করল রাঙা।

রাঙার কথায় সম্বিত ফিরে পেল সেলিম। বলল, ‘তোমাকে আজ অপূর্ব লাগছে।’

প্রশংসা শুনে হাসল রাঙা। জিজ্ঞেস করল, ‘কখন লাগে না শুনি?’ তা ঠিক বলেছে রাঙা। তাকে কখন সুন্দর লাগে না তা এক রহস্য বটে। সেলিমের কাছে রাঙা সবসময় সুন্দরী। এই একজন সুন্দরী বউ পেয়েছে বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। সেলিমের প্রশংসা অগ্রাহ্য করে রাঙা বলল, ‘অনেক হয়েছে। প্রশংসা পড়ে করলেও চলবে। এখন রওনা দেওয়া যাক। না হয় দেরী হয়ে যাবে।’

রাঙার কথায় মাথা নাড়াল সেলিম। বউকে নিয়ে বের হলো। একটা ট্যাক্সি ডেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলো দু’জন।

কয়েকমাস হলো রাঙা প্রেগন্যান্ট। কিছুদিন পরই সেলিম ও রাঙার ঘর আলো করে আসবে নতুন অতিথি। এ অবস্থায় শাড়ি পড়তে অসুবিধা হলেও মানিয়ে নিয়েছে রাঙা। প্রিয় বন্ধুর জন্য এটুকু করাই যায়।

সাকিব আহমেদের গল্প “দস্যিপনা” 

নয়নের দেশে ফেরার অবশ্য বিশেষ কারণ আছে। কিছুদিন পর নয়নের বিয়ে। না, এখনো বিয়ের সবকিছু ঠিক হয়নি। তবে হতেও আর বাকি নেই। নয়নের বিয়ের পুরো বন্দোবস্ত করেছে রাঙা। রাঙার এক বান্ধবীর ছোট বোনকে নয়নের জন্য পছন্দ করেছে সে। প্রথমে বিয়ে করবে না, করবে না বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও রাঙার নাছোড়বান্দা স্বভাবের জন্য অবশেষে রাজী হয়েছে নয়ন।

তবে এর জন্য বেশ কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে রাঙাকে। নয়নকে রাজী করাতে না পেরে নয়নের বাবা-মা’র সাথে যোগাযোগ করে রাঙা। সবকিছু বলে, এমনকি পাত্রীর পরিবারের সাথেও যোগাযোগ করিয়ে দেয় রাঙা। মেয়েকে প্রথম আলাপেই পছন্দ করে ফেলে রাঙার বাবা-মা। পরিবার যেখানে রাজী হয়ে গিয়েছে তাই পরে আর নয়নও আপত্তি করেনি। তাছাড়া রাঙা নয়নের জন্য যেই মেয়েকে পছন্দ করেছে সে যে লাখে একটা হবে, জানে নয়ন। রাঙা যে নয়নের জন্য সাধ্যের মধ্যে সেরাটাই বেছে আনবে সেটা ভালোই জানে নয়ন।

মেয়েটার সাথে দুই একবার ফোনে কথা হলেও এখনো দেখেনি নয়ন। বেশ কয়েকবার ভিডিও কলে দুইজনকে একসাথে আনার চেষ্টা করে রাঙা, কিন্তু পারেনি। নয়নকে রাজী করানো সম্ভব হয়নি। নয়নের এক কথা, দেশে ফিরেই আলাপ হবে। এছাড়াও, রাঙা যেই মেয়েকে পছন্দ করেছে তাকে দেখার প্রয়োজন মনে করে না নয়ন। এসব বলেই এড়িয়ে গেছে বারবার। তাই রাঙা আজকের দিনেই দুইজনের দেখা করানোর ব্যবস্থা করেছে।

এসব ভাবতে ভাবতে এয়ারপোর্টের সামনে এসে থামল ট্যাক্সি। সেলিমের সাথে নামল রাঙা। ভাড়া মিটিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল দু’জন। আর কিছু মিনিট, এরপরই নয়নকে দেখতে পাবে রাঙা। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর!

সময়ের কাটায় মাত্র দশ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। ইতোমধ্যেই অস্থির হয়ে উঠেছে রাঙা? ফ্লাইট ল্যান্ড করার সময় হয়ে গিয়েছে তো! এতক্ষণে যে চলে আসার কথা? দেরি হচ্ছে কেন? ফ্লাইট ডিলে ছিল? সেলিমও রাঙার এই অস্থিরতা কমাতে পারছে না।

এমন সময় দূর থেকে আসতে দেখা গেলো নয়নকে। নয়নকে দেখতে পেয়ে যেমন উত্তেজনা অনুভব করার কথা, তেমন অনুভব হচ্ছে না! অবাক লাগল রাঙার। অথচ কিছুক্ষণ আগেই কেমন এক অস্থিরতা অনুভব করছিল রাঙা। মনে হচ্ছে, এই তো সেদিন দেখা হয়েছিল দু’জনের। পাঁচ বছর তো কেবলই এক সংখ্যা।

আগের মতোই আছে নয়ন। না, না। চুলগুলো একটু বড় হয়েছে মনে হচ্ছে। আগে এমন বড় চুল রাখত না নয়ন। একটু দাঁড়িও আছে দেখা যাচ্ছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে নয়নকে।

রাঙার সামনে এসে হাসল নয়ন। ঠিক আগের মতোই আছে হাসিটা। কিছু না বলে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রাঙা। দু’চোখ ভিজে যাচ্ছে রাঙার। নয়নও অনুভব করল, তারও দুই চোখের কোণে পানি।

দুইজনই নিজেদের চোখের পানি আড়াল করে একে অপরকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করল। ‘কেমন আছিস?’ জিজ্ঞেস করল রাঙা।

সাকিব আহমেদের গল্প “কাব্যকথা”

‘আগে কেমন ছিলাম জানি না,’ হাসিমুখে জবাব দিলো নয়ন। ‘তোদের দেখার পর থেকে ভালো আছি।’

সেলিমের সাথে হাত মিলিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল নয়ন। বন্ধুর জামাই বলে কথা! প্রথম দেখা, অথচ মনে হচ্ছে কতদিনের চেনা। নয়ন তো এমনই। রাঙা বলেছে, নয়ন খুব সহজেই সবাইকে আপন করে ফেলতে পারে। আর সে কারণেই তো নিজের বিয়ে করা বউ অন্য এক পুরুষকে জড়িয়ে ধরছে দেখেও কিছু বলতে পারছে না। নয়ন আর রাঙা। দুইজনকেই যে বিশ্বাস করে সেলিম।

সেলিমকে ছেড়ে এয়ারপোর্টের চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে আনলো নয়ন। কাউকে যেন খুঁজছে। ‘আব্বু-আম্মু আসেনি?’ জিজ্ঞেস করল নয়ন।

‘না,’ রাঙার জবাব। ‘বাসায় আছে।’

‘বাসায় কেন?’

আমি তোকে নিয়ে যাবো। তাছাড়া, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’

‘কি সারপ্রাইজ?’

‘তা তো বলা যাবে না। বাসায় গেলে দেখতে পাবি।’ এই বলে চুপ হলো রাঙা। আর কিছুই যেন বলবে না। অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলো নয়ন। এবার ধরল সেলিমকে।

‘আপনার বউ যে এমন করছে, কিছু বলুন তো!’ সেলিমকে বলল নয়ন।

‘আমি কিছু জানি না ব্রাদার।’ বলল সেলিম। ‘আপনার বন্ধুর সাথে ঝামেলা আপনিই মেটান।’

‘কিছু মেটাতে হবে না,’ বলল রাঙা। ‘এখন বাসায় চল। সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।’

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে এলো তিনজন। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে বাড়ির পথে রওনা হলো নয়ন। কি সারপ্রাইজ, ভাবছে নয়ন। রাঙার সারপ্রাইজগুলো বিশেষ ধরণের হয়। যা নিতে পারে না নয়ন। তাই ভয়, শঙ্কা, কৌতূহল মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

সাকিব আহমেদের গল্প “বিজয়োল্লাস”

নয়নের বাড়ির সামনে এসে থামল ট্যাক্সি। ভাড়া মিটিয়ে দিলো সেলিম। নয়ন ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করলেও, রাঙা তা হতে দেয়নি। রাঙার সোজা কথা, আজকের পুরো খরচ সেলিমের। নয়নের পকেট খালি করার জন্য আরও দিন পড়ে আছে। হাসিমুখে রাঙার আবদার মেনে নিলো নয়ন।

 

নিজের বাসার গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে উঠল নয়ন। নিজের বাড়ি! কত্ত দিন পর এই বাড়ির আঙিনায় পা রাখছে!

‘কি হলো, চল।’ বলল রাঙা। রাঙার সাথে করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল নয়ন। পিছন পিছন আসছে সেলিম। বাড়ির ভেতর পা রাখার সাথে সাথে যা ঘটল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না নয়ন। দরজার বেল বাজানোর সাথে সাথেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু কাউকে না দেখে বেশ অবাক হলো নয়ন। কে খুলল দরজা? দরজার ওপাশে নয়নের বোন তিথি থাকলেও খেয়াল করেনি নয়ন। খেয়াল করার কথাও না।

ভেতরে প্রবেশ করল নয়ন। সঙ্গে সঙ্গে একসাথে তিন চারটা বেলুন ফাটার আওয়াজ। সাথে ম্যাজিক স্প্রে অপ্রস্তুত করে দিয়েছে নয়নকে। এই তাহলে রাঙার সারপ্রাইজ!

সারপ্রাইজ অবশ্য শেষ হয়নি এখনো। একটি মেয়ে হাতে ফুলের তোরা নিয়ে নয়নকে বরণ করে নিলো, যেন বিশ্বজয় করে ফিরেছে নয়ন। এই মেয়েটি অনন্যা, নয়নের সাথে যার বিয়ের কথা পাকা করেছে রাঙা। রাঙার কল্যাণে মেয়েটির এত ছবি দেখেছে, চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল না। এক পলকেই চিনে ফেলেছে নয়ন।

অপ্রস্তুতভাবে অনন্যার হাত থেকে ফুলের তোরা নিলো সে। মেয়েটার চোখের দিকে তাকালো। লাজুক চোখে অদ্ভুত এক মায়া। মুহূর্তেই ভালো লেগে যায় সেই মায়াবী কাজল কালো দু’চোখ। প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে ভালো লেগে গেল নয়নের। নাহ, রাঙার সত্যিই পছন্দ আছে।

তিথি এসে জড়িয়ে ধরল নয়নকে। অনেকদিন পর বড় ভাইয়ের দেখা পেয়েছে, ছাড়বেই না যেন। বাহু ধরে ভাইকে নিয়ে এলো ডাইনিং টেবিলের সামনে। সেখানে নয়নের বাবা, মা আর ছোট ভাই শাফিল আছে। আর আছে দুইজন অপরিচিত মানুষ। যাদের চেনে না নয়ন। অনুমান করল, উনারা হয়ত অনন্যার মা, বাবা। নয়নের হবু শশুর-শাশুড়ি।

ডাইনিং টেবিলের মাঝে বিশাল একটা রক কেক। যেখানে লেখা, ‘Noyon, Welcome to Home.’ এই কাজ যে রাঙার, বেশ বুঝতে পারল নয়ন। ও ছাড়া এমন পাগলামি কেউ করবে না। সাথে অবশ্যই তিথিও যুক্ত হয়েছে। দুইজন মিলেই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।

‘কেমন লাগল সারপ্রাইজ?’ জিজ্ঞেস করল রাঙা।

জবাব দিলো না নয়ন। শুধু বলল, ‘তুই বড় হবি না? এমন বাচ্চাই থেকে যাবি?’

‘অবশ্যই।’ জবাব দিলো রাঙা। ‘বড় তো সবাই হয়, আমি না হয়, বাচ্চাই থাকলাম!’

‘হ্যাঁ, কয়েকদিন পর তোর বাচ্চা হলে, মা আর বাচ্চা দুইজনকেই ফিডার গিফট করব।’ বলল নয়ন।

‘হয়েছে,’ নয়নকে থামিয়ে বলল রাঙা। ‘এখন কেক কেটে আমাকে উদ্ধার কর।’ তাগাদা দিলো রাঙা। কেক কাটতে যাবে নয়ন। এমন সময় বাঁধা দিয়ে বলল, ‘একটু দাঁড়া।’

দূরে এক কোণে দাড়িয়ে আছে অনন্যা। তাকে নিয়ে এসে নয়নের পাশে দাড় করিয়ে দিলো রাঙা। বলল, ‘যার সাথে সারাজীবন থাকতে হবে, তার পাশে এখন দাঁড়ালে ক্ষতি নেই।’ একটু থেমে রাঙা বলল, ‘এবার কেক কাট।’

লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো অনন্যা। কিছু না বলে কেক কাটল নয়ন। এখানেই সারপ্রাইজের শেষ নেই। কিছুক্ষণ পর সবার সামনে রাঙা ঘোষণা দিলো, আজই হবে নয়ন-অনন্যার এংগেজমেন্ট। নিজের ব্যাগ থেকে একটি স্বর্ণের আংটি বের করে নয়নের হাতে দিলো। বলল, ‘পড়িয়ে দে।’

লজ্জায় লাল হয়ে উঠল অনন্যার ফরসা মুখ। প্রথমবার মেয়েটির হাত ধরল নয়ন। কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি! এক ভালো লাগায় ছেয়ে উঠলো মন। অনামিকা আঙুলে পড়িয়ে দিলো ভালোবাসার প্রথম উপহার। নতুন জীবনের প্রথম ধাপে এগিয়ে গেলো দুইজন।

বাঙালীয়ানা

বিয়ের দিন আসতে বেশি সময় নেই। দুই পরিবার মিলে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেছে। এখন শুধু কার্য বাস্তবায়নের অপেক্ষা। পুরো দায়িত্ব হাতে নিয়েছে রাঙা। একা হাতে সামলাচ্ছে সবকিছু। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এত দৌড়ঝাঁপ করতে মানা করছে সবাই। কে শোনে কার কথা? রাঙার এক কথা, নিজের বেস্টফ্রেন্ডের বিয়েতে সব নিজের মনের মতো করে সাজাবে। এসব শুনে আফসোস হয় নয়নের। সে তো রাঙার বিয়েতে থাকতে পারেনি!

আর নয়নের বোন তিথি। ওর ব্যাপার হয়েছে একে তো নাচুনে বুড়ি তার ওপর ঢোলের বাড়ি। রাঙার সাথে সেও তাল মিলিয়ে হইচই করে বাড়ি মাথায় করে রাখছে। বিয়ের শপিং করা থেকে শুরু করে ডেকোরেশন, প্ল্যানিং, কিভাবে কি হবে সব দায়িত্ব নিয়ে বসে দুজনে। আর এসবে কলুর বলদের মতো খাটছে সেলিম। নয়নের বারণ কানেই নিচ্ছে না রাঙা। নয়ন কিছু সাহায্য করতে গেলেও, রাঙার নিষেধ। জামাই মানুষের কাজ করতে হবে না। কি আর করার! চুপচাপ বসে সব দেখছে নয়ন।

স্বপ্নে বাংলাদেশ, স্বপ্নের বাংলাদেশ

আজ নয়নের বিয়ে। বিয়েবাড়িতে উৎসবের রং। নয়নের কাজিন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনে ভরপুর বিয়েবাড়ি। রাঙা এখনো এসে পৌঁছেনি। কাল সারারাত নয়নের হলুদের অনুষ্ঠান একাই মাতিয়ে রেখেছিল রাঙা। সকাল সকাল নিজের বাসায় গিয়েছে। বলেছে, দুপুরের মধ্যে চলে আসবে।

কাজিনদের সাথে গল্প করছে নয়ন। হাসি তামাশায় মেতে উঠছে। এমন সময় নয়নের মোবাইল বেজে উঠল। সেলিম ফোন করেছে। ভিড় আর কোলাহল ঠেলে উঠে গিয়ে আড়ালে যেয়ে ফোন রিসিভ করল। নয়ন কিছু বলার আগেই অপর প্রান্ত থেকে সেলিমের হাহাকার। এরপর কিছু শোনার প্রয়োজন ছিল না। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেছে। তা তোলার মতো সময়ও নেই। ওই অবস্থায় বের হয়ে এলো। শুধু সবাইকে এতটুকু জানালো, রাঙার এক্সিডেন্ট হয়েছে।

হাসপাতালে এসে সেলিমকে অসহায় অবস্থায় বসে থাকতে দেখলো নয়ন। নয়নকে দেখেই যেন আবেগের ঝাঁপি খুলে দিলো সেলিম। সেলিমকে কি করে সান্ত্বনা দেবে নয়ন বুঝছে না।

সেলিম জানালো, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বাথরুমে স্লিপ করে পড়ে গিয়েছিল রাঙা। আঘাতটা পেটে সবচেয়ে বেশি লেগেছে কারণ উপুড় হয়ে পড়েছিলো। ডাক্তার অপারেশন টেবিলে নিয়ে গেছে, কি হবে না হবে এখনই কিছু বোঝা যাচ্ছেনা।

টেনশনে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে নয়নের। অপারেশন কখন শেষ হবে? রাঙার কিছু হয়ে গেলে? নাহ, আর ভাবতে পারছে না নয়ন।

এমন সময় অপারেশন কক্ষ থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এলো। ডাক্তারের চোখে মুখে খারাপ কিছুর আভাস। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো নয়নের।

ডাক্তার জানালো, ‘মেয়ে সন্তান হয়েছে। কিন্তু…’

‘কিন্তু কি ডাক্তার?’ জিজ্ঞেস করল সেলিম।

‘মাকে বাঁচাতে পারিনি আমরা। অনেক চেষ্টা করেছিলাম। একজনকেই বাঁচানো সম্ভব ছিল। মেয়ে তুলনামূলক সুস্থ থাকায় তাকেই বাঁচানো গিয়েছে।’

আর কিছু শুনতে পারেনি নয়ন। আর কিছু শোনার মতো অবস্থাও ছিল না। একবার রাঙাকে দেখতে চাইলো সে। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে রাঙাকে দেখতে গেলো নয়ন। একজন নার্স এসে রাঙার মেয়েকে তুলে দিলো সেলিমের হাতে।

রাঙা শুয়ে আছে নিথর, নিস্তব্ধ। সবসময় চঞ্চল, হাসি আনন্দে থাকা মেয়েটা কথা বলছে না। রাঙাকে এভাবে থাকতে দেখে নয়ন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। অবাক হয়ে উপলব্ধি করল, সে কাঁদছে না। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না। অথচ তারই সবচেয়ে বেশি কাঁদার কথা ছিল। অধিক শোকে মানুষ নাকি পাথর হয়ে যায়। তবে কি নয়ন সত্যি সত্যিই পাথর হয়ে গিয়েছে? আগের চেয়ে অনেক বেশি?

এবং মাশরাফি…

রাঙাকে কবরের মাঝে শোয়ানো হয়েছে বেশি সময় হয়নি। সবাই চলে গিয়েছে। শুধু যেতে পারেনি নয়ন। এখান থেকে চলে যাবে, রাঙাকে ছেড়ে চলে যাবে – এ শক্তিটুকু যেন পাচ্ছে না সে। রাঙা ভুতের ভয় পেতো খুব। এই কবরস্থানে একা থাকবে কি করে মেয়েটা!

অথচ পাঁচ বছর আগে কত সহজেই না রাঙাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল নয়ন। নিজের অভিমানকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। রাঙার দুঃখ-কষ্টের মূল্য সে সময় দেয়নি। সেই অভিমানেই কিনা আজ রাঙা চলে গেল! নয়ন তো ফিরে এসেছিল। ফিরে এসেছিল নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটির কাছে। প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর যাবে না। কোনোদিনও যাবে না রাঙাকে একা ফেলে।

কিন্তু রাঙা? সে যে নয়নকে একা ফেলে চলে গেলো! সে জায়গা থেকে যে আর ফিরতে পারবে না রাঙা। চাইলেও ফিরতে পারবে না, কিছুতেই পারবে না…

রানা, ভালো আছিস তো?

পেপার’স লাইফ/গল্প/সাকিব আহমেদ