ড্রয়িংরুম থেকে চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে। এত চিৎকার কিসের? পুরো বাড়ি যেন মাথায় তুলছে চিৎকার করে। কৌতূহল জাগলো। নিজের বিছানাতে উঠে বসলাম। বালিশের পাশে হাতড়ে খুঁজে নিলাম নিজের চশমা। চোখে চাপিয়ে লাঠিটা হাতে নিলাম। বয়স হয়েছে, এখন আর ঠিক মতো হাটতে পারি না। এই লাঠিই ভরসা। চপ্পলে পা গলিয়ে উঠে দাঁড়াতেই যেন কষ্ট হয়। কাঁপা কাঁপা পায়ে হাটতে হাটতে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোতে লাগলাম। দরজার কাছে পৌঁছে দেখি, এ এক এলাহি কাণ্ড!
আমার নাতি হৃদ ও নাতনী তানহা লাফাচ্ছে আর চিৎকার করছে। তাদের মা, মানে আমার বৌমা হৃদ ও তানহাকে থামানোর চেষ্টা করছে। কে শোনে কার কথা? ওদের থামার কোনো লক্ষণই নেই।
আমাকে দেখে দৌড়ে আসলো হৃদ। জড়িয়ে ধরল আমাকে। ‘দাদু, আমরা জিতে গেছি।’, চিৎকার করতে করতে বলল হৃদ।
জিতে গেছি? কিসে জিতলাম? কে জিতলো? ‘কোথায় জিতলাম দাদু?’ হৃদকে জিজ্ঞেস করলাম। ‘কে জিতলো?’
‘বিশ্বকাপে,’ হৃদ জবাব দিলো। ‘আজকে সেমিফাইনাল ছিল। বাংলাদেশ জিতে গেছে। এখন ফাইনাল খেলব। ইউএসএ’র সাথে।’
খুব অবাক হলাম কথাটা শুনে। বাংলাদেশ কি তাহলে বিশ্বকাপ ফুটবলে সুযোগ পেল? তাও আবার ফাইনাল খেলবে! আমাদের সময় বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবে সেটা চিন্তা করাই ছিল দুঃস্বপ্ন।
আমার ভুলটা ভাঙলো একটু পরেই। হৃদকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাংলাদেশ ফুটবল বিশ্বকাপে সুযোগ পেল কবে থেকে?’
‘আরেহ দাদু,’ জবাব দিলো তানহা। ‘ফুটবল না, ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলছে বাংলাদেশ।’
মুহূর্তে মনের মধ্যে যে উত্তেজনা কাজ করছিল, তা নিমিষেই নিভে গেল। শেষ যখন বাংলাদেশকে ক্রিকেট খেলতে দেখেছি, তাতে ফাইনাল খেলা নিতান্তই অমূলক নয়। এত বছর পর ফাইনাল খেলছে বাংলাদেশ, তাতেই বরং অবাক লাগছে।
‘তুমি খুশি হও নাই দাদু?’ জিজ্ঞেস করল হৃদ।
‘খুশি হবো না কেন?’ জবাব দিলাম। ‘আমার দেশ ফাইনাল খেলছে, আমি খুব খুশি।’
‘আমরা ফাইনাল খেলা দেখতে যাবো,’ বলল তানহা। ‘তুমিও যাবে আমাদের সাথে। মজা হবে।’
প্রথমে যাবো না চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু কেন যেন মনটা ডাকছে। বাংলাদেশের ফাইনাল যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাদেরকে কথা দিলাম যাবো। আবার দেখব বাংলাদেশের খেলা। আবারও লাল-সবুজের জন্য উল্লাস করব, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করব।
বাংলাদেশ ফাইনাল খেলছে! কত বছর লাল সবুজের রঙে রাঙা হয় না! কত দিন বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা হয় না! এতগুলো বছর পর বাংলাদেশের খেলা দেখতে যাবো, তাও আবার ফাইনাল। কেমন যেন রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ছি, ঠিক যৌবনকালের সে সময়ের মত।
বয়স হয়েছে বলে এখন আর বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছা করে না। এই চার দেয়ালের মাঝেই শান্তি। অথচ একসময় বাসায় থাকতে ইচ্ছা করত না।
স্বপ্নে বাংলাদেশ, স্বপ্নের বাংলাদেশ
ক্রিকেট খেলা দেখি না অনেক অনেক বছর হলো। সেই যে, ক্রিকেট বিশ্বকাপকে প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ন করার জন্য আইসিসি বিশ্বকাপের দল কমিয়ে এনেছিল সেদিন থেকেই আগ্রহ কমেছে। এরপর কখন যে খেলা দেখা বাদ দিয়ে দিয়েছি, বলতে পারব না। এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে। আজ আবার ক্রিকেটের রোমাঞ্চে রোমাঞ্চিত হতে চলেছে।
ফাইনাল বলে কথা! বাংলাদেশ ফাইনাল খেলছে, তাও আবার বিশ্বকাপের। এমন দিন ঘরে বসে মিস করার কোনো মানেই হয় না। সুযোগ যখন হয়েছে, তখন দেখতে চাই। কেমন খেলে বাংলাদেশ? পরিবারের সবাই মিলেই দেখতে চলেছি ফাইনাল। স্বপ্নের ফাইনাল! অন্তত আমার জন্য তো স্বপ্নেরই মতো।
হৃদ বলেছে, এখন নাকি মিরপুরে আর খেলা হয় না। বিশ্বের সব থেকে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম এখন বাংলাদেশে। পূর্বাচলে নতুন স্টেডিয়াম তৈরি হবে শুনেছিলাম। সেটা যে এত বড় করে তৈরি করা হবে ভাবতে পারিনি। সেই মাঠেই আজ ফাইনাল খেলবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের খেলা দেখার আগ্রহ তো আছেই, সেই সাথে বিশ্বের বড় স্টেডিয়াম দেখার কৌতূহল বাড়ছে।
হৃদের কাছে সে স্টেডিয়ামের বর্ণনা শুনতে শুনতে আরও রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ছি। হৃদের কাছে জানতে পারলাম, এখন নাকি টেস্ট খেলা হয় না। ৫০ ওভারের খেলাও নাকি কালে ভদ্রে হয়। বছরে একটি টুর্নামেন্ট দিয়েই দায় মুক্ত হতে চায় সবাই। তবে টি-টোয়েন্টি প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তানহা বলেছে, এবার নাকি ৩২টি দল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছে। শুনে আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল। আমাদের সময় তো ১০ দলের বিশ্বকাপ নিয়ে কত যুদ্ধ! দল বাড়াতে হবে। কিন্তু আইসিসি কোনোভাবেই দল বাড়ানোর চেষ্টা করেনি। আমলে নেয়নি বড় বড় রথী মহারথীদের কথা।
তানহা ও হৃদের কাছে এখনকার ক্রিকেটের গল্প শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার রাজ্যে চলে এসেছে। বিশ্বাস হয় না কিছুই।
এখন নাকি সব দলকেই বিশ্বকাপ খেলতে বাছাইপর্ব খেলতে হয়। এবারের বিশ্বকাপে সেই বাঁধা পেরোতে পারেনি পাকিস্তান।
ভাবা যায়! এশিয়া অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের ধারে কাছে কোনো দল নেই। এশিয়া থেকে সর্বোচ্চ দশটি দল বিশ্বকাপ খেলে। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে যুক্ত করা হয়েছে এশিয়া অঞ্চলে। মোট বারোটি দল সুযোগ পায় এশিয়া অঞ্চল থেকে। ইউরোপ থেকে আটটি দল খেলে বিশ্বকাপে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে চারটি করে দল সুযোগ পায়।
এত সব হৃদের কাছ থেকে জানতে পারলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। ঠিক যেন ফুটবল বিশ্বকাপ! চীন-জাপান নাকি অনেক এগিয়ে গেছে ক্রিকেটে। তবে সবথেকে বেশি এগিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সাথে নেপালও খুব ভালো খেলে। তবে অনেকটাই পিছিয়েছে ভারত। এখন আর আগের সেই জৌলুস নাকি নেই। কোনোমতে বিশ্বকাপে সুযোগ পেলেও উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারে না এখন।
তানহা, হৃদের কাছে ক্রিকেটের গল্প শুনতে শুনতে কখন যে স্টেডিয়ামে পৌঁছে গেছি, টেরই পাই নি। ট্যাক্সি থেকে বের হয়ে হাঁটা ধরলাম। স্টেডিয়ামের গেটে উপচে পড়া ভিড়। এত ভিড় দেখতে ভালোই লাগছে। বাংলাদেশ ফাইনাল খেলছে, ভিড় তো হবেই। লাল-সবুজের এই দলটির জন্য কত আবেগ, কত ভালবাসা! উপলব্ধি করলাম, এতগুলো বছরেও এই ভালোবাসোগুলো বিন্দুমাত্র কমেনি।
ভিড় ঠেলে অবশেষে প্রবেশ করলাম মাঠে। গ্যালারি জুড়ে লাল সবুজের বিশালতা। কি অদ্ভুত সুন্দর! তার চেয়েই বেশি সুন্দর মাঠটি। এত সুন্দর, বিশাল মাঠ বাংলাদেশে আছে ভাবাই যায় না। অন্তত আমাদের সময় ভাবতে পারতাম না। অবশ্য আজকের বাংলাদেশকেই তো কেউ আগে ভাবেনি।
পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ রব। লাল সবুজের জার্সি চারিদিকে। মাঠের সাথে গ্যালারীও যেন একাত্মতা প্রকাশ করেছে। সবুজের মাঝে লালের মিশেল যেন অদ্ভুত সৌন্দর্যের প্রতীক। এক পাশে বিশাল পতাকা উড়ছে, যেন বিজয়ের গান গাইছে।
হঠাৎ মনে হলো, আমার জার্সিটা পড়ে আসা উচিত ছিল! হোক পুরনো জার্সি, তাও তো বাংলাদেশের। নিজের পুরনো জার্সিগুলো আলমারিতে সযত্নে রেখে দিয়েছি বছরের পর বছর। কেউ জানে না, কেবলই আমি জানি। এখন তো আর গায়ে চাপানো হয় না। তানহা, হৃদ অবশ্য নতুন জার্সি পড়েই খেলা দেখতে এসেছে।
খেলা শুরু হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। টসে জিতে বাংলাদেশ প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র করবে ব্যাটিং।
প্রথম ওভারের খেলা শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের মাইকেল ও জনসন ব্যাটিং করতে নেমেছে। বল হাতে বাংলাদেশের অভি। হৃদ বলল, অভি নাকি বিশ্বের সবচেয়ে গতিময় বোলার। কিছুদিন আগে নাকি শোয়েব আখতারের ১০০ মাইল স্পিডের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। শুনেই আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে, যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। বিশ্বাস হতে চায় না কিছু।
হৃদ যে ভুল কিছু বলেনি, তার প্রমাণ পেলাম প্রথম বলেই। অভির গতির ঝড়ে উপড়ে গিয়েছে স্ট্যাম্প। হওয়ায় ভাসতে ভাসতে গিয়ে পড়েছে অনেকটা দূরে।
প্রথম বলেই উইকেট। পুরো গ্যালারি কাঁপছে উল্লাসে। নিজের বয়স, সীমাবদ্ধতা ভুলে আমিও সবার সাথে মেতে উঠলাম। ঠিক অনেক বছর আগের মতো করে।একের পর এক গতিতে যখন যুক্তরাষ্ট্রকে কাঁপাচ্ছে অভি, ঠিক তখনই ফায়াজের স্পিন বিষে বেসামাল হওয়ার অবস্থা। ফায়াজের স্পিন মনে করিয়ে দিচ্ছে সাকিব আল হাসানকে। ফায়াজের রূপে সাকিবই যেন ভয়ংকর এক রুদ্র মূর্তি ধারণ করেছে।
পাওয়ার প্লেতে নেই তিন উইকেট। ৬ ওভারে স্কোর বোর্ডে ৩ উইকেট হারিয়ে ৪২।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা, যুক্তরাষ্ট্রকে চেপে ধরার আশা যখন উঁকি দিচ্ছে ঠিক তখনই ড্যানিয়েলের ব্যাটে করে এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক এক সামলিয়েছে বাংলাদেশকে। চার ছয়ের ফুলঝুরিতে বুকে কাঁপন ধরে, মনে শঙ্কা জাগে।
৬ ওভারে যখন ছিল ৪২, ১৫ ওভার শেষে তা ১৩৭। মাত্র চার উইকেট হারিয়ে। অধিনায়ক সাদমানের কপালে চিন্তার ভাঁজ। কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই আক্রমণে অভিকে ফিরিয়ে এনেছে সাদমান।
অভির গতিকেও যেন ভয় পায়না ড্যানিয়েল। প্রথম চার বলে চারটি চার মেরে সাদমান, অভির মনোবলই যেন ভেঙে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক। স্টেডিয়াম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। কিভাবে কি করা যায় উপায় খুঁজছে অভি।
তার মাথায় কি ভাবনা ছিল, কে জানে? বোধহয় চিন্তা করছিল জীবনের সেরা একটি বল করতেই হবে। ওভারের পঞ্চম বলটা আসলো বুলেটের গতিতে। প্রায় ১০০ মাইল গতিতে ধেয়ে আসা বলটি ছিল একদম ইয়র্কার। ড্যানিয়েল এই বলেও চেয়েছিল চার্জ করতে।
কিন্তু পারেনি। পায়ের কাছে পড়া বলটি ব্যাট পেরিয়ে আঘাত হানে স্ট্যাম্পে। স্ট্যাম্প মাটি থেকে উপড়ে অনেক দূরে গিয়ে পড়ল।
আবারো সরগরম গ্যালারি। পরের বলেও জোরের উপর করা বলটি সজোরে চালাতে চেয়েছিল নতুন ব্যাটসম্যান এন্ড্রু। ব্যাটের কানায় লেগে বল আকাশে উঠে গিয়েছে। অভি নিজেই ছুটছে বল ধরতে। এবং ব্যর্থহীন ভাবেই বল ধরে পরপর দুই বলে দুই আউট করে আবারো বাংলাদেশকে খেলায় ফিরিয়ে এনেছে অভিই।
পরপর দুই উইকেট হারিয়ে যেই চাপে পড়েছিল সেখান থেকে ফিরে আসা দুঃসাধ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। শেষ চেষ্টা করেও শেষ চার ওভারে তুলেছে মাত্র ২৯ রান। যেই সময় রানের ফোয়ারা ছোটানোর কথা, সেই সময় রানের লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশের বোলাররা ১৮২ রানে থামিয়ে রেখেছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটিকে।
বিশ্বের ক্ষমতাধর, তবে ক্রিকেটে? এখন দেখার বিষয়, সেই জায়গায় কতটা ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। নাকি বিজয়ের মুকুট মাথায় চাপিয়ে ক্রিকেট পাগল জাতিকে আনন্দে ভাসাবে বাংলাদেশ।
বিরতির সময়ে এবার শুধু অপেক্ষা। ১৮২ রান স্কোর বোর্ডে বড়, কিন্তু অসম্ভব কিছু নয়। তানহা এদিকে দোয়া দরুদ পড়ছে দেখলাম। হৃদ হিসেব কষছে বিজয়ের। আমারও যে চিন্তা হচ্ছে না তা নয়, এবার মনে হচ্ছে বাংলাদেশ পারবে।বাংলাদেশকে যে পারতেই হবে। কয়েক দশক আগে একের পর এক ফাইনাল হারতে দেখেছি। সেই কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এবার অন্তত তা চাই না। আমার নাতি নাতনিরা সেই কষ্ট সহ্য না করুক এবার।
হোক না, বিজয়ের গল্প। হোক না, বিজয়ের উল্লাস। এবারও চোখের জল ফেলতে চাই – যে জয় হবে বিজয়ের, হবে আনন্দের।
১৫ মিনিট বিরতির পর খেলা শুরু হবে আবার। বাংলাদেশের জয়ের জন্য লক্ষ্য ১৮৩ রান। এই অল্প সময়টা যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। ক্রমেই মন অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। শুরু হতে আর কত দেরি?
হৃদ একটু পরপর ঘড়ি দেখছে। আমার মতো তারও যে এই সময়ের অপেক্ষা অসহ্য লাগছে বুঝতে পারছি। নাতিটা ঠিক আমার মতই হয়েছে। খেলা পাগল। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য পাগল। এমনটি দেখে বুকটা গর্বে ভরে উঠছে।
এমন সময় দেখা গেল, সাইড লাইন পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়রা মাঠে নামছে আম্পায়ারদের সাথে। মাঠে নামছে বাংলাদেশের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান আহসানুল হক ও রাকিব হোসেন।
চাপা উত্তেজনা কাজ করছে মনের মাঝে। কি হয়, কি হয়! এই চিন্তা যেন ভর করছে প্রতিনিয়ত। বিপুল করতালি, উল্লাস আর চিৎকারে বাংলাদেশের শুরুর দুই ব্যাটসম্যানকে অভিবাদন জানালো দর্শকরা। পুরো গ্যালারি ফেটে পড়বে যেন।
প্রথম বল করতে আসবে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ। বাংলাদেশের রাকিব স্ট্রাইক প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত। দেখেশুনে শুরু করা বাংলাদেশের প্রতিটি শট কিংবা ঠেকিয়ে দেওয়া প্রত্যেক বলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে গ্যালারিতে উপস্থিত থাকা লাল-সবুজের সমর্থকরা।
দেখে শুনে শুরুর পরও কিছুটা মারমুখী, কিছুটা দায়িত্বশীল দুই ব্যাটসম্যান। ছয় ওভারে শেষে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৪৭ রান স্কোর বোর্ডে। উইকেট টিকে থাকলে রান আসবেই। এই মন্ত্রেই যেন বিশ্বাসী দুই ব্যাটসম্যান ভুল পথে পা বাড়াতে নারাজ।
তবে ফাইনালের উত্তেজনা! সেকি কোনো বাঁধা মানে? সাবধানী শুরুর পরও হঠাৎ খেই হারিয়ে যাওয়া। যার শুরু রাকিবের উইকেট দিয়ে। ফিলিপসের জোরের উপর করা বল লং অনের উপর দিয়ে উড়িয়ে মারতে চেয়েছিল রাকিব। কিন্তু ক্যাচের বিনিময়ে যখন ফিরে যেতে হচ্ছে, তখন যেন পুরো বাংলাদেশই উল্টো পথে হাঁটছে।
একে একে আহসানুল, অন্তর, তৌহিদরা আউট হলে ১৩ ওভার শেষে বাংলাদেশের সংগ্ৰহ ৪ উইকেটে ১০২। শেষ সাত ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ৮১ রান।
অধিনায়ক সাদমান ও বর্তমান সময়ের সেরা ফিনিশার দীপ্ত এখন ক্রিজে। শেষ চেষ্টা করতে হবে ওই দুইজনকেই। দুইজনই আত্মবিশ্বাসী। প্রতিটি শটেই যেন নির্ভরতা, বিজয়ের প্রচেষ্টা। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে জয়ের পথে।
১৪তম ওভারে ১২, এবং ১৫তম ওভারে ১১ রানের পর শেষ পাঁচ ওভারে প্রয়োজন ৫৮ রান। এবার হাত খুলে খেলতে হবে। এর যেন কোনো বিকল্প নেই।
সাদমান কিংবা দীপ্ত দুইজনেই ভালভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে বিষয়টি। তাই পরের বল থেকেই মারমুখী। সাদমানের ব্যাটে কখনো চার, ঠিক পরের বলেই দীপ্তর মাঠ পার করা ছয়।
শেষ দুই ওভারে প্রয়োজন ২০। এমন সময় উড়িয়ে মারতে গিয়ে সীমানার প্রান্তে ক্যাচ হয়ে সাদমানের ফিরে যাওয়ায় যেন শঙ্কা জাগে আবারো। তবে ১১ বলে ২০ কঠিন কিছু নয়।
এবার রিস্ক নিতেই হয়। তাই লেট অর্ডারে খেলা ফায়াজকে কিছুটা আগেভাগেই নামানো হলো হাত খুলে খেলার জন্য। দীপ্তর সাথে করে ১৯তম ওভারের পরের পাঁচ বলে দশ রান নীল ফায়াজ।
শেষ ওভারে প্রয়োজন ১০ রান। ব্যাট হাতে দীপ্ত। প্রথম বলে এক্সট্রা কাভারের পাশ ঘেঁষে দুর্দান্ত শট। সেই সাথে অসাধারণ ফিল্ডিংয়ের বিনিময়ে দুই রান। পরের বলটি ইয়র্কার। পায়ের উপর পড়া বলটি অসাধারণ ভাবে ঠেকিয়েই সিঙ্গেল। চার বলে প্রয়োজন ৮। পরের বলে সিঙ্গেল নিয়ে দীপ্তকে স্ট্রাইক প্রান্তে এনে দিল ফায়াজ। বোলারের মাথার উপর দিয়ে শট করে চতুর্থ বলে দীপ্ত দুই রান নিলে শেষ দুই বলে দরকার পাঁচ রান।
এবার প্রয়োজন একটি চার অথবা ছয়। দীপ্ত কি ভাবছিল তখন, তা হয়ত সে-ই ভালো বলতে পারবে। একবার গ্যালারির দিকে তাকালো সে। হয়ত ভাবল, এই লাল সবুজের সমর্থনের জন্যই আজ জিততে হবে।
আমার পাশে বসা হৃদ দোয়া দরুদ পড়ছে। দুই হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়ালাম আমি। এমন পরিস্থিতিতে বসতে পারব না। আগেও পারতাম না, এখনও পারে সম্ভব না। খেলা না দেখলেও যে ভালোবাসা, আবেগগুলো আগের মতোই আছে।
বোলার দৌড় দিল বল হাতে নিয়ে। অনেকটা ওয়াইড ইয়র্কারের মত। কিন্তু হাফ ভলি হয়ে যাওয়া বল সজোরে কাট করল দীপ্ত। পয়েন্টের পাশ দিয়ে বল সীমানার বাইরে। পুরো গ্যালারি গগনবিদারী চিৎকারে কাঁপছে।
বিশ্ব জয়ের থেকে মাত্র যে এক রান দূরে! অনেক চিন্তাভাবনা, কালক্ষেপণ করে করা ম্যাচের শেষ বলে আলতো ভাবে ব্যাট ছুঁয়েছে দীপ্ত। ব্যাটে বল লাগার আগেই ফায়াজের দৌড়, ব্যাটে বল লাগিয়েই দৌড় দীপ্তর। থ্রো করার আগেই প্রান্ত বিনিময়। বাংলাদেশ জিতেছে, হয়েছে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন।
খেলোয়াড়গুলো দৌড়ে মাঠে ঢুকে পড়েছে। জড়িয়ে ধরেছে দীপ্তকে। পুরো গ্যালারি লাল সবুজের রঙে ছেয়ে গেছে। উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা।
হৃদ আর তানহা সবার সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করছে। আমিও ভুলে গেছি আমার বয়স। ভুলে গেছি স্থান-কাল-পাত্র। সব ভুলে সবার সাথে সেই উল্লাসে আমিও সামিল। দু’চোখ দিয়ে সমানে অশ্রু পড়ছে। এই আনন্দের কান্না কত দিন কাঁদা হয় না!
আমার হাত থেকে লাঠিটা পড়ে গেছে। সেদিকে অবশ্য নজর দেওয়ার সময় কোথায়? এ আনন্দ যে বাঁধনহারা। কোনোকিছুর বাঁধা মানে না।
এমন সময় স্টেডিয়ামের বড় স্ক্রিনে দুইটি অবয়ব দেখা গেল। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে শরীর। চামড়ায় এসেছে কুঁচকানো ভাব। ঠিক মত হাটতে যেন কষ্ট হয় তাদের। অন্যের কাঁধে বড় দিয়ে মাঠে প্রবেশ করছে, আশীর্বাদ করছে বিশ্বজয়ী দলটিকে।
বার্ধক্যে অবয়বে পরিবর্তন এলেও আমার বিন্দুমাত্র চিনতে অসুবিধা হলো না। তাদের ভুলি কি করে? তারাই কে একসময় স্বপ্ন দেখিয়েছিল। একজন মাশরাফি বিন মর্তুজা আরেকজন সাকিব আল হাসান।
তাদের হাত দিয়েই বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিটা তুলে দেওয়া হলো বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়কের হাতে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। স্বপ্নের মতো লাগছে সবকিছু। এখনো যেন ঘোরের মধ্যে আছি।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ হলো। ঘোর কেটেছে অনেকটা। আমার লাঠিটা আর পাইনি। ভিড়ের মধ্যে কোথায় যে পড়ে গেছে!
তানহা আর হৃদ দুইজন আমার দুই হাত ধরে রেখেছে। নাতি-নাতনীদের হাত ধরে বেরিয়ে এলাম স্টেডিয়াম থেকে।
‘দাদু, যেই দুইজন পুরস্কার দিলো তাদের খেলা তুমি দেখেছ?’ প্রশ্ন করল হৃদ।
‘হুম, দাদু।’ আমি জবাব দিলাম। ‘তাদের খেলা দিয়েই তো একসময় বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতাম।’
‘কেমন খেলত তারা?’
‘আজকের বাংলাদেশ যে তাদের হাত দিয়েই গড়ে উঠেছে। একটু একটু করে, অনেক বোঝা মাথায় নিয়ে।’ হৃদের কথার জবাব দিয়ে যেন সেই পুরনো দিনে ফিরে গেলাম হঠাৎ করে। সেই উত্থানের গল্প যে সবকিছুকে হার মানায়। ‘সে অনেক গল্প, দাদু।’ হৃদকে বললাম।
‘আমাকে শোনাবে সে গল্প?’ হৃদ জিজ্ঞেস করল।
‘শোনাবো একদিন।’ হৃদের কথার জবাব দিয়ে সেই যে চুপ হলাম সেদিন আর কথা বলিনি। ট্যাক্সি দিয়ে বাসায় ফেরার পথে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে এ দেশটাকে। অনেক বেশি তৃপ্ত লাগছে। শেষ কবে এমন শান্তি নিয়ে ছিলাম জানি না, মনে পড়ে না।
আজকের দিনটা একটু বেশি মধুর, অনেক বেশি প্রশান্তির। চোখের সামনে ভাসে বিজয় উল্লাস, চোখের সামনে ভাসে মাশরাফি-সাকিবের বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া মুখ। আমিও যে বৃদ্ধ হয়েছি। সময়ের পালা বদলে সব বদলালেও এ দেশটা বদলায়নি, এদেশের ক্রিকেট বদলায়নি!
পেপার’স লাইফ/গল্প/সাকিব আহমেদ